Skip to main content

|| A Journey to Remember - উত্তরাখন্ডের চম্বা ||

 ===================================================

 “The impulse to travel is one of the hopeful symptoms of life”

                                                – Agnes Repplier

উত্তরাখন্ডের তেহরি গাড়োয়াল জেলার এক ছোট্ট শহর চম্বা | এই একই নামের আরেকটি শৈল শহর হিমাচলপ্রদেশে রয়েছে, সেই চম্বা অবশ্য ভারতবর্ষের পর্যটন মানচিত্রে সুপরিচিত একটি নাম | অন্যদিকে এই চম্বা এখনও বহির্জগতের অগোচরেই রয়ে গেছে | ফলে আর বাকি পাঁচটা ট্যুরিস্ট স্পটের মতো এখনো পাঁচমিশালী লোকের পদভারে পিষ্ট হয়ে যায়নি এই জায়গা | সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে  সোয়া পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই শহরের আয়তন মাত্র চার বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ছয় হাজার | মূল চম্বা শহর আহামরি কিছু সুন্দর না হলেও এর আশেপাশের জায়গা ভারী সুন্দর | এই পুঁচকে শহরকে ঘিরে রয়েছে পাহাড়ের সারি আর পাইন-দেওদারের জঙ্গল | এরকমই এক পাহাড়ী জঙ্গলের ধারে, চম্বা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে এক নির্জন জায়গায় অবস্থিত ‘মার্কারী হিমালয়ান এক্সপ্লোরেশন’ (MHE) নামক ভ্রমণসংস্থার পরিচালিত ক্যাম্পে থাকবার অভিজ্ঞতা নিয়েই এই লেখা |
                               পাহাড়ে ঘেরা চম্বা শহর                      চিত্রঋণ– মার্সেলা
 ক্যাম্পের গেট ..দূরে দেখা যায় চম্বা শহরকে  
গেট দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়বে এই দৃশ্য 
সামনে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে পাহাড়ের সারি 
২০১১ আর ২০১২ – পরপর দু’বছরের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আমি এই ক্যাম্পে বেড়াতে গিয়েছিলাম | সে সময় আমি মধ্যপ্রদেশের গোয়ালীয়র শহরের একটি বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করতাম | সেই স্কুল থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরের আয়োজন করা হত | এক এক দঙ্গল কচিকাঁচার সাথে পাঁচ-ছয় জন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা যেতেন, যাওয়া-আসা নিয়ে মোট ছয় দিনের ট্যুর | দারুণ মজা হতো | ২০১১ আর ২০১২ – দু’বছরেই আমি ক্লাস সিক্সের বাচ্চাদের সাথে গিয়েছিলাম চম্বার ওই ক্যাম্পে | এই ক্যাম্পের সূত্রেই তাঁবুতে থাকা, ট্রেকিং, রিভার-রাফটিং ইত্যাদি নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সাথে আমার প্রথম পরিচয় |
সার বেঁধে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁবুগুলো 
                                    তাঁবুর ভিতরে                         চিত্রঋণ – মার্সেলা 
গোয়ালীয়র থেকে ভোপাল-জনশতাব্দী ধরে দিল্লি আর সেখান থেকে দেরাদুন এসি এক্সপ্রেসে হরিদ্বার | হরিদ্বার থেকে চম্বার দুরত্ব ৮৫ কিলোমিটার | বাসে করে এই রাস্তাটুকু আসতে মোটামুটি আড়াই ঘন্টা সময় লাগে | যেকোনো পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ারই এক বড় প্রাপ্তি আঁকা-বাঁকা উঁচু-নীচু পাহাড়ি রাস্তার সফরটুকু | গন্তব্যের চেয়েও যেন বেশি সুন্দর লাগে এই পথটুকুকে | হরিদ্বার থেকে চম্বার রাস্তাও তার ব্যতিক্রম নয় | পাহাড়ের গা ঘেঁষে সর্পিল পাকদন্ডি বেয়ে এগিয়ে চলে গাড়ি, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে খাদের অন্যপারের ধাপচাষের দাগকাটা পাহাড়ি ঢাল, দুরের পাহাড়ি পাইনের জঙ্গল, সেই সঙ্গে আকাশে মেঘ-রোদের লুকোচুরি খেলা | এর মাঝেই একসময় এসে পৌঁছালাম চম্বায় | এরপর সেই ছোট্ট শহরের ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে আরো পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসে অবশেষে হাজির হলাম আমাদের গন্তব্যস্থানে | ওয়েবসাইটে এই ক্যাম্পের ঠিকানা হিসাবে লেখা আছে –      “বাদশাহ ঠৌল, রানীচোরি মোটর রোড, চম্বা, উত্তরাখন্ড – 249145” 
‘বাদশাহ ঠৌল’ আর ‘রানীচোরি’ – বড় অদ্ভুত এই নামদুটোর পারস্পরিক সহাবস্থান ! ঠৌল’ শব্দের অর্থ জমায়েত বা সমাবেশ | কবে কোন সুদূর অতীতে একঝাঁক রাজারাজড়ার মজলিশ থেকে কে কোন রানীকে চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল কে জানে !!

চম্বা শহর
এই সেই রানিচোরি মোটর রোড 
MHE-এর ক্যাম্পের জায়গাটা যেন এক টুকরো স্বর্গ | পাহাড়ের ঢালে অল্প খানিকটা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁবুগুলো | ক্যাম্পের সীমানার একপাশে রয়েছে পাইনের জঙ্গল, অন্যপাশে আট-দশটা বাড়ি নিয়ে একটা ছোট্ট জনবসতি | পিছন দিয়ে চলে গেছে নির্জন রাস্তা | সেই রাস্তার পিছনেই আবার শুরু হয়েছে পাহাড়ী জঙ্গল | ক্যাম্পের সামনের সামনের দৃশ্যটা জাস্ট অসাধারণ | সেখানে অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে সারি সারি পাহাড় | সেই একগুচ্ছ পাহাড়ের একটার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চম্বা শহরের ঘরবাড়ি গুলো  | রাতের বেলায় সেই শহরকে এত দূর থেকে যেন একটা জ্বলন্ত তারামাছের মতো দেখায় |  সকালে ঘুম থেকে উঠে উত্তরদিকে তাকালে দেখা যায় শ্বেতশুভ্র তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ ‘বান্দরপুঁছ’, এটি গাড়োয়াল হিমালয়ের একটি প্রধান পর্বতশৃঙ্গ | আর সূর্যাস্তের সময় আকাশে আর সারিবদ্ধ পাহাড়ের গায়ে লাগে রঙের খেলা |

ক্যাম্পের পিছনদিকে রয়েছে পাহাড়ি জঙ্গল 
পাইনের বনের সামনে, একদল কচিকাঁচার সাথে   
ওই দুরে দেখা যায় চম্বা শহরকে 
উত্তর দিকে তাকালে দেখা যায় বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গ ‘বান্দরপুঁছ’
সূর্যাস্তের সময় আকাশে লাগে রঙের হোলি 
        ঝোপঝাড়ে বন্দী সূর্যদেব 
ঠিক যেন হাফ-বয়েল ডিমের কুসুম !!


পাঁচ দিন ও চার রাত্রির এই ট্যুর ছিল নানা রোমাঞ্চকর কর্মসূচিতে ঠাসা | প্রথমদিন ব্রেকফাস্টের পর ছিল নানারকম অ্যাডভেঞ্চার অ্যাক্টিভিটি যেমন- Flying fox, Valley crossing ও Burma bridge | এসব জিনিসকে আমি আজীবন ভয় করেই এসেছি, কিন্তু আজ ক্যাম্পের ট্রেনারের তত্ত্বাবধানে ওই একরত্তি বাচ্চাগুলোকে অনায়াসে ঐসব কান্ডকারখানা করতে দেখে সাহস করে ‘জয় মা’ বলে আমিও দড়ি ধরে ঝুলে পড়লাম
উপরের দুটো ছবি burma bridge-এর (চিত্রঋণ – মার্সেলা), নিচের বাঁ দিকের ছবিটা valley crossing (চিত্রঋণ – দেবদত্ত নাথ), আর ডান দিকেরটা flying fox-এর  
না,  চিন্তা নেই, দড়িটা ছেঁড়ে নি !

সূর্যাস্তের পর অন্ধকার পাহাড়ি জঙ্গলে আমাদের সান্ধ্যভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হল | নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে টর্চের আলোয় পথ দেখে চলতে লাগলাম আমরা | মিনিট কুড়ি পথ চলার পর আমরা একটা ছোট মাঠের মতন সমতল পরিষ্কার জায়গায় এসে পৌঁছালাম , ট্যুর ইনস্ট্রাক্টরের নির্দেশে আমরা সেখানে সবাই টর্চ নিবিয়ে খোলা আকাশের তলায় চুপ করে মিনিট দশেক বসে রইলাম | সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, ঠিক বলে বোঝানো যাবে না | ওখান থেকে ফেরার পথে কাছেই কোথাও একদল বন্য কুকুর হঠাৎ তারস্বরে চিত্কার শুরু করল, বুঝলাম ওদের রাজ্যে এই অসময়ে একদল বিন-বুলায়ে-মেহমানকে ওরা মোটেই পছন্দ করছে না, শেষমেশ অবশ্য ওরা নিজে থেকেই চুপ করে গেল |
অন্ধকার জঙ্গলে সান্ধ্যভ্রমণ (যেটুকু আলো দেখা যাচ্ছে সেটা ক্যামেরার ফ্ল্যাশের জন্য !) 
ক্যাম্পে ফিরে দেখি অগ্ন্যুৎসবের (bonfire) আয়োজন করা হয়েছে (বস্তুতঃ শুধু এদিন নয়, ট্যুরের প্রতিদিনই আমরা bonfire করেছিলাম ) | আগুনের চারদিকে গোল করে বসে মজলিস শুরু হলো, সঙ্গে গরম চা আর নুডলস-স্যুপ | আমাদের ছাত্রদের মধ্যে বেশ কিছু সিকিমি ছেলে ছিল, তারা কয়েকটা সিকিমি গান গেয়ে শুনালো | কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে বসে আগুন পোহাতে পোহাতে সেই গানগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যে কোনো এক অজানা সিকিমি গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি |
                       সন্ধ্যা নেমে আসে মায়াবী রূপ নিয়ে         (চিত্রঋণ – মার্সেলা)
                                          উত্তাপ                      (চিত্রঋণ – মার্সেলা)


দ্বিতীয় দিন আমরা গেলাম চম্বা থেকে 22 কিলোমিটার দূরে, 2757 মিটার (9976 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত গাড়োয়ালের বিখ্যাত সুরকন্ডা (Surkanda) দেবীর মন্দিরে | মন্দিরের নিচের গাড়ি-পার্কিং জোন থেকে 3 কিলোমিটার খাড়াই পথ হেঁটে পৌঁছতে হয় এই মন্দিরে | দেবীমাহাত্ম্য ছাড়াও এই মন্দিরের ভৌগলিক অবস্থান উল্লেখযোগ্য | মন্দিরের প্রাঙ্গণ থেকে চারিদিকের যে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা যায় তা এক কথায় অনির্বচনীয় |  আকাশ পরিষ্কার থাকলে খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায় উত্তর দিকের উত্তুঙ্গ হিমালয়ের শ্বেতশুভ্র পর্বতশ্রেণী |
মূল মন্দিরের সামনে 
হনুমানজীর সাথে একগুচ্ছ হনুমান
 প্রভব, চেঙ্গিস, অমৃত আর য়োহেন এর সাথে 
চারিদিকের নয়নাভিরাম দৃশ্য 
                     মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা দেবতাত্মা হিমালয়ের দিকে      (চিত্রঋণ - মার্সেলা)


দেবীদর্শনের পর আমরা গেলাম মন্দির থেকে আট কিলোমিটার দুরে অবস্থিত ‘ধনৌলটি’ (Dhanaulti) নামক ছোট্ট জনপদে | দেওদার, রডোডেনড্রন আর ওক গাছের জঙ্গলে ঘেরা এই ছোট্ট জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটটি চম্বা ও মুসৌরীর সংযোগকারী রাস্তার ধারে অবস্থিত, এখান থেকে মুসৌরীর ও চম্বার দুরত্ব যথাক্রমে 24 ও 29 কিলোমিটার | জায়গাটা পিকনিকের পক্ষে আদর্শ, ফলে ট্যুর অপারেটর এখানেই আমাদের মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন |
সুন্দরী ধনৌলটি 
আকাশছোঁয়া গাছের নীচে 


পেল্লায় সাইজের ভুঁড়িটা না থাকলে ছবিটা আরো ভালো হতো !!

ধনৌলটিতে পিকনিক লাঞ্চ  
খাওয়াদাওয়ার পর ক্যাম্পে ফেরার পথে গাড়ি দাঁড়ালো চম্বা শহরের প্রাণকেন্দ্রে | মাত্র ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এই পুঁচকে শহর আমরা হেঁটে ঘুরে নিলাম | যারা শপিং করতে ভালবাসেন এই চম্বা তাঁদের যারপরনাই হতাশ করবে | আমি তো একশ’ টাকাও খরচ করতে পারিনি এখানকার দোকান-বাজার ঘুরে !! 

চম্বা শহরের ব্যস্ততা 

এরকম জায়গায় একটা বাড়ি হলে মন্দ হতো না !!


তৃতীয় দিন সকালে আমাদের প্রকৃতি-ভ্রমণে (nature-walk) নিয়ে যাওয়া হলো | পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শিশিরে ভেজা নরম পথ ধরে ঘন্টাখানেক হাঁটা | কানে আসে জানা-অজানা নানা পাখির ডাক, চোখে পড়ে রং-বেরঙের নানা পাহাড়ি ফুল ও লতাপাতা | মাঝেমাঝে গাছের পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে গায়ে এসে পড়ে ‘কচি লেবুপাতার মত নরম রোদ' | বিশুদ্ধ হিমেল বাতাসে মন-প্রাণ সতেজ হয়ে ওঠে |


                               সকালে হাঁটতে বেরিয়ে                    (চিত্রঋণ – দেবুদা)  
এদিন ব্রেকফাস্টের পর আমরা গেলাম ভাগীরথী নদীর উপর নির্মিত ‘তেহরি বাঁধ’ (Tehri dam) দেখতে | ভারতবর্ষের উচ্চতম এই বাঁধের নির্মানকার্য 1978 সালে শুরু হলেও তা সম্পূর্ণ হয় 2006 সালে | বাঁধের ইঞ্জিনিয়ার-কাম-গাইডরা আমাদের ছাত্রদের এই বাঁধের কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করে বোঝালেন | তেহরি ড্যামের কাছেই ভাগীরথীর জলে জলবিহারের  বন্দোবস্ত আছে, আমরা সবাই মিলে সেখানে বোটিং করলাম  |
পাহাড়ের কোলে ভাগীরথী নদী 

ভাগীরথী 

দক্ষিণী ডন মুত্তুস্বামী 

তেহরি ড্যাম

তেহরি ড্যাম 
এদিন ক্যাম্পে ফিরে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাচ্চাদের জন্য ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’র আয়োজন করা হয়েছিল | আগের দিন চম্বা শহরের বাজার থেকে এই উদ্দেশ্যে আমরা আর্ট পেপার, পেন্সিল-রবার, প্যাস্টেল, জল রং-তুলি ইত্যাদি কিনে এনেছিলাম | ছবি আঁকার বিষয় ছিল এই ক্যাম্প সংক্রান্ত নানা অভিজ্ঞতা বা চারিদিকের নৈসর্গিক দৃশ্য | ছাত্রদের পাশাপাশি আমিও উৎসাহিত হয়ে কাগজ-পেন নিয়ে আঁকতে বসে গেলাম |
বাচ্চারা মন দিয়ে ছবি আঁকছে 


আমার আঁকা ছবি 





চতুর্থ দিন সকালে আমাদের তাঁবু খাটানো (tent pitching) সেখান হল | ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরোলাম ট্রেকিংয়ে | কখনো পাহাড়ি শস্যক্ষেতের পাশ দিয়ে, কখনো বা পাহাড়ি ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলা | পাহাড়ের রূপের সঙ্গে নিবিড়তম অন্তরঙ্গতা অনুভব করতে হলে এই ট্রেকিংই সর্বোত্তম পন্থা | ঘন্টা দু’য়েক পথ চলার পর এক জায়গায় থেমে আমরা লাঞ্চ সেরে নিলাম | আরো ঘন্টা তিনেক (সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ ঘন্টা) হাঁটার পর আমরা গন্তব্যস্থানে এসে পৌঁছলাম |

                  মহাসমারোহে চলছে তাঁবু খাটানোর প্রাকটিস      (চিত্রঋণ – মার্সেলা)

                                 পথ চলার শুরু                (চিত্রঋণ – মার্সেলা)
  The road less traveled 
                           solitude                   (চিত্রঋণ – মার্সেলা)
                              পাহাড়ি শস্যক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পথ চলা       (চিত্রঋণ – মার্সেলা)
চরৈবেতি
                                   চলতি কা নাম গাড়ি            (চিত্রঋণ – মার্সেলা)
আমি আর লুকাস 
চারিদিকের উঁচু টিলা আর পাইনের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা অনেকটা সমতল জায়গা – অনেকটা একটা বাটির (bowl) মতো আকৃতি বিশিষ্ট এই জায়গাটা | এটাই আমাদের আজ রাতের আস্তানা | হৈ হৈ করে মহা সমারহে ছাত্ররা তাঁবু খাটিয়ে ফেলল, আমরা মাস্টারমশাই-দিদিমনিরাও হাত লাগলাম |
                            সবাই মিলে তাঁবু খাটানোর পর              (চিত্রঋণ – দেবুদা)

                             চারিদিকে উঁচু গাছের সারি                 (চিত্রঋণ – দেবুদা)

                ছোট্ট তাঁবুর মধ্যে ইশান, নিখিল, প্রতীক আর পপাই       (চিত্রঋণ – দেবুদা)

The Geren Family
উপরের ছবিটি মার্ক গেরেন ও তার পরিবারের | 2011 সালে এই মার্কিন পরিবারটি আমাদের সাথে চম্বা বেড়াতে গিয়েছিল | পোর্টল্যান্ড নিবাসী স্কুল-শিক্ষক মার্ক ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’-এ (Fulbright scholarship)  ছয় মাসের জন্য আমাদের স্কুলে এসেছিলেন শিক্ষকতা করতে |  মার্কের সাথে তার স্ত্রী মার্সেলা, মেয়ে সিয়েনা ও ছেলে লুকাস-ও এদেশে এসেছিল |  মার্সেলার ফোটোগ্রাফির খুব শখ, এই ব্লগে দেওয়া ফটোগুলোর অনেকগুলোতেই দেখবেন photo courtesy ওকে দেওয়া হয়েছে |
বিশালদেহী মার্কের পাশে আমাকে রীতিমতো লিলিপুট লাগছে !! (চিত্রঋণ – মার্সেলা)
তাঁবু খাটানোর পর আমরা সবাই মিলে জঙ্গল থেকে কাঠ জোগাড় করে আনলাম, তাতে আগুন জ্বালিয়ে ম্যাগি রান্না করা হল | ম্যাগিকে এর আগে এত সুস্বাদু কখনো মনে হয়নি ! এরই মধ্যে আমাদের ছাত্ররা চারদিক থেকে রাশি রাশি pine-cone  জোগাড় করে আনলো, সন্ধ্যার পর  bonfire আয়োজন করার জন্য |

দুই মিনিটের ম্যাজিক, ভাগ্গিস তখন কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না এর উপর !!
                    লুকাস আর রাশিকৃত পাইনের cone             (চিত্রঋণ – মার্সেলা)
ঝুপ করে পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে এলো | চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু যেখানে ক্যাম্পের স্টাফরা রান্নাবান্না করছেন সেখানে দুটো গ্যাসের আলো (পেট্রোম্যাক্স) জ্বলছে | আর অন্যদিকে আমরা শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে স্তুপীকৃত pine cone-এ আগুন ধরিয়ে চারদিকে গোল হয়ে বসেছি | এই গা ছমছমে পরিবেশে বাচ্চারা আমায় ধরল ভূতের গল্প বলার জন্য, কিন্তু দু-তিনটে গল্প বলতেই দেখি বাচ্চারা ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে, নিজেদের মধ্যে গা ঘেঁষাঘেষি করে বসছে ! খানিক পরে খাওয়ার ডাক এলো, খাওয়াদাওয়ার পর আমরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম
টর্চ আর গ্যাসের স্তিমিত আলোয় চলছে ডিনার 



‘যার শেষ ভালো তার সব ভালো’ |  বোধহয় এজন্যই ট্যুরের সবথেকে বড় আকর্ষণকে শেষ দিনের জন্য বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে  | পঞ্চমদিন সকালে চম্বার ক্যাম্প থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমরা হৃষিকেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, গঙ্গাবক্ষে rafting করার জন্য |  হৃষিকেশে আমরা এসে উঠলাম MHE-এর  রিসর্ট ‘Bull’s Retreat’-এ | লাঞ্চের পর আমরা গিয়ে পৌঁছালাম গঙ্গার তীরে | নদীর গর্জনে এখানে কান পাতা দায় | আধঘন্টার ছোট্ট ট্রেনিং সেশনের পর আমরা শুরু করলাম rafting | সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা | নদী যেখানে শান্ত সেখানে রাফটে বসে হালকা চালে দাঁড় টানার পাশাপাশি ফটোশ্যুট করা, নদীর জলে ঝাঁপিয়ে raft-এর দড়ি (raft perimeter rope) ধরে সাঁতার কেটে এগোনো |  আর নদী যেখানে উচ্ছ্বল (rapid) সেখানে শক্ত হাতে অবিরাম প্রাণপন দাঁড় টানা | তখন প্রতি মুহুর্তে মনে হয় যে এই বুঝি raft উল্টে গেল !! এই rapid গুলোর সবকটার আলাদা আলাদা নাম আছে, হৃষিকেশের গঙ্গার কয়েকটা বিখ্যাত rapid-এর নাম হল – Sweet sixteen, Cross fire, Three blind mice,  The wall, Roller coaster, Golf course, Double troubleReturn to the sender | এরই কয়েকটা পার করে রামঝুলা ও লছমনঝুলার নীচ দিয়ে গিয়ে ঘন্টাখানেক পর অবশেষে আমরা পৌঁছালাম হৃষিকেশের ঘাটে | 
                    ভেসে যাওয়ার আগের মুহূর্তে (২০১২ সাল)          চিত্রঋণ – দেবুদা 

সহকর্মী মৃগাঙ্ক পান্ডের (হিন্দী শিক্ষক) সাথে - ২০১১ সাল
উচ্ছসিত কচি-কাঁচার দল 
জলকেলি

 ‘গঙ্গা নদীর মাঝি’
রাফটিং পর্ব শেষ করে আমরা গেলাম হৃষিকেশের ঘাটের ধারের আশ্রমে | সেখানে  সন্ধ্যারতি দেখে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা ফিরে এলাম হোটেলে | সেখানে campfire, তারপর ডিনার করে ব্যাগপত্তর নিয়ে চেপে বসলাম দিল্লীগামী বাসে | সারারাতের সফরের পর ভোর নাগাদ বাস দিল্লি পৌঁছালো, সেখান থেকে ভোপাল-জনশতাব্দী চেপে সকাল দশটা নাগাদ গোয়ালীয়র এসে পৌঁছালাম |

হৃষিকেশের আশ্রমের সন্ধ্যারতি 

সাতটা দিন যেন ঝড়ের বেগে কেটে গেল ! অনেকগুলো রঙিন ভালোলাগার মুহূর্ত পেরিয়ে আমরা আবার সাদা-কালো জীবনে ফিরে এলাম | সঙ্গে রইলো স্মৃতি আর ওখানে তোলা একগাদা ফটো | মাঝেমাঝেই মন খারাপের মুহুর্তে এই ফটোগুলো আমায় নিয়ে যায় সেই ভালোলাগার দেশে |
পুনশ্চ:
1. MHEএর ওয়েবসাইটের লিংকটা নিচে দিলাম | ফোন নম্বর সহ যাবতীয় তথ্য ওখানেই পাওয়া যাবে | http://www.mheadventures.com/
2.  সবশেষে আসি খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গে | MHE-এর চম্বা ক্যাম্পের খাওয়াদাওয়া এক কথায় অসাধারণ | সকালে ব্রেকফাস্টে টোস্ট,ওমলেট,আলুর পরোটা, পুরি-ভাজি, দালিয়ার পায়েস – ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব পেয়েছি | দুপুরে প্রতিদিন নিরামিষ খাবার পরিবেশন হতো | বিনা সারে ফলানো সব্জিপাতির কি অপূর্ব স্বাদ ! বিকালে স্ন্যাকস হিসাবে চা-কফি, আলু কিম্বা ফুলকপির পকোড়া | সন্ধ্যাবেলা campfireএর সময় পেতাম চা-কফি আর ন্যুডলস-স্যুপ | রাতে দু’দিন ভেজ আর তিনদিন নন-ভেজ (মুরগির মাংস) পরিবেশিত হয়েছিল | ওখানে একদিন পালং-মুরগি কারি (palak-chicken) বানিয়েছিল, দুর্দান্ত হয়েছিল খেতে !!
_________________________
© অর্ঘ্য দাস, দুর্গানগর, ১৬-০১-২০১৬
বিঃ দ্রঃ : চিত্রঋণ সম্বলিত ছবিগুলো বাদে বাকি ছবিগুলো লেখকের তোলা এবং সেগুলির স্বত্ব লেখকের দ্বারা সংরক্ষিত 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...
  ঝাড়গ্রাম : বসন্ত ১৪২৭ স্কুল পাশ করেছি সতেরো বছর হয়ে গেল | তারপর এই প্রথম আমার সুযোগ হলো স্কুলের বন্ধুদের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার | দু তিনটে জায়গা মাথায় ছিল – ঘাটশিলা , ঝাড়গ্রাম, অযোধ্যা পাহাড় | এই বসন্তের শুরুতে তিনটে জায়গাই মনোরম | শেষমেষ ঝাড়গ্রাম WBFDC এর গেস্ট হাউসের ছবি দেখে সেটাই ফাইনাল করা হলো | 6 ই মার্চ, 2021, শনিবার          ডিমসেদ্ধ : সকাল সাড়ে দশটা - ক্যালেন্ডারে মার্চের শুরু হলেও বেজায় গরম. আমি দরদর করে ঘামছি ডেবরা চৌমাথায় (পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) দাঁড়িয়ে, হাতে আমার একুশটা হাঁসের ডিম সেদ্ধ, সাথে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি এবং সাদা ও কালো নুন | এক সপ্তাহ আগে করা প্ল্যান অনুযায়ী আমরা নাকি আগামী দু’ ঘন্টায় গাড়িতে বসে পার হেড পাঁচটা করে হাঁসের ডিম খাবো | ওদিকে সৌমাভ ওর গাড়িতে গোল (সুমিত্র) আর পকাই (অর্ক) কে নিয়ে আসছে কলকাতা থেকে |          বব মার্লে : শেষমেষ আমায় প্রায় ঘন্টা খানেক রোদে দাঁড় করানোর পর তাঁরা এলেন এবং বসন্তের এই অকাল দাবদাহ থেকে আমায় মুক্তি দিলেন | ঠান্ডা গাড়িতে উঠে ওদের আনা এগ স্যান্ডউইচ আর কোলাঘাট KFC থেকে কেনা মুর...