ভুলভুলাইয়া, বিরিয়ানি, টুন্ডে কাবাব, চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবী......
To-do লিস্টে এই কটা জিনিস ছিল মাস্ট | যেদিন ঠিক হয়েছে লক্ষ্ণৌ
ঘুরতে যাব সেদিন থেকেই নামগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল | ঐতিহাসিক জায়গার প্রতি
আমার আজন্ম দুর্বলতা | সেই সঙ্গে মোগলাই খাবারের দুর্নিবার হাতছানি | লোভনীয়
কম্বিনেশন !!
আমাদের কলকাতার মতই লক্ষ্ণৌ শহরের অনেকগুলো রূপ | গোমতীনগর যেন সল্টলেক আর রাজারহাটের সংমিশ্রন,
হজরতগঞ্জ যেন পার্কস্ট্রিট, আমিনাবাদ যেন খিদিরপুর | একদিকে শহরের শতাব্দী প্রাচীন সত্তা, অন্যদিকে যুগের সাথে
তাল মিলিয়ে ঝাঁ-চকচকে মেট্রোপলিটন হবার আপ্রাণ চেষ্টা |
যে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম তারা থাকেন গোমতীনগরের এক বহুতল আবাসনে |
ওদের ফ্ল্যাটটা তিন তলায় | সুসজ্জিত বিশাল ফ্ল্যাট | জানলা
খুললে আকাশ দেখা যায় না, চারদিকের বিশাল বিশাল বাড়িতে ঢাকা পড়েছে আকাশের নীল রং | তবে
এগারো তলা বাড়ির ছাদে উঠলে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায় |
স্থানীয় লোকেদের ভাষায় লক্ষ্ণৌ হল নবাব, কাবাব, আদাব আর শবাব-এর শহর |
কথাটা ভুল নয় | শহরটা জুড়ে বেশ একটা নবাব নবাব গন্ধ | নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলতে
গেলে ভুলভুয়াইয়ার থেকেও বড়া ইমামবাড়ার ছাদটা আমার অনেক বেশি ভালো লেগেছে | গোধূলিবেলার
মায়াবী আলোয় ওখান থেকে লক্ষ্ণৌ শহরটাকে ভারী সুন্দর দেখায় | এছাড়াও ছোটা ইমামবাড়া,
রুমী দরওয়াজা, ঘন্টা ঘর, ব্রিটিশ রেসিডেন্সি, ছত্তর মঞ্জিল – সবেতেই ইতিহাস বাসা
বেঁধে আছে |
____________________________________________________________________________
_____________________________________________________________________________
লক্ষ্ণৌর কাবাব আর বিরিয়ানির নাম শুনলেই পেটুক বাঙালির জিভে জল চলে আসে | এখানকার নিজস্ব কাবাব টুন্ডে গলৌটি কাবাব খেতে পৌঁছে গেছিলাম আমিনাবাদ | যদিও এই টুন্ডে (গলৌটি) কাবাব জিনিসটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি | তবে গোমতীনগরের ‘দ্য মুঘলস দস্তরখোয়ান’ রেস্তোরার মাটন বিরিয়ানি আর মসালা চিকেন – এই দুটো পদ ছিল অনবদ্য |
‘আদাব’ শব্দের অর্থ সম্মান ও বিনম্রতা | লখনৌ শহরের মানুষের আতিথেয়তা
নিয়ে অনেক মজাদার গল্প শুনেছি, যদিও সেসব চাক্ষুষ করার তেমন সৌভাগ্য বা সময় হয়নি
এবার | তবে এই শহরের শবাব (সৌন্দর্য) মুগ্ধ করেছে আমাদের | শহরের যেটুকু জায়গা আমরা গাড়িতে চড়ে দেখেছি, তার
থেকেও বেশি দেখেছি খোলা রিক্সায় চেপে ! বস্তুতঃ কোনো জায়গাকে ভালো করে ঘুরে দেখতে
হলে রিক্সা নামক বাহনটির জুড়ি নেই, বাসে কিম্বা প্রাইভেট গাড়িতে সেই মজা নেই | পুরোনো এই শহরের জায়গায় জায়গায় সুদৃশ্য মসজিদ, দরগা, গম্বুজাকৃতি
চুড়োযুক্ত নানা সরকারী প্রতিষ্ঠানের বাড়ি | চারবাগ রেল স্টেশনটিও মানানসই | আর আছে
পুরো শহরজুড়ে একগুচ্ছ পার্ক | বেশ কয়েকটাকে বাইরে থেকে দেখলেও ঢুকেছি মাত্র একটায় –
জনেশ্বর মিশ্র পার্কে | রাতের আলোয় বাইরে হেকে আলোয় ঝলমল আম্বেদকর পার্ক দেখে খুব
ভালো লেগেছে, কিন্তু সময়াভাবের কারণে ওখানে ঢুকতে পারিনি |
আগ্রায় গেলে অটোওয়ালারা যেমন হ্যান্ডিক্রাফ্টসের দোকানে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করে, সেরকম লক্ষ্ণৌ শহরের রিক্সাওয়ালারাও ‘চিকন ফ্যাক্টরী’ তে নিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে | ব্যাঙের ছাতার মত এই শহরের আনাচে-কানাচে রয়েছে চিকনের দোকান | দরাদরিতে পারদর্শী না হলে একদর-মার্কা দোকানে যাওয়াই শ্রেয় | আর কাবাব বিরিয়ানির ক্ষেত্রেও সতর্কতা নেওয়ার দরকার, কারণ একই নামের গুচ্ছের দোকান রয়েছে | মোদ্দা কথায়, চারদিকেই পাতা আছে জালিয়াতির ফাঁদ |
আমাদের লক্ষ্ণৌ যাত্রার সবচেয়ে মজাদার অভিজ্ঞতা হল যে দম্পতির ( আমার শ্যালিকা ও ভায়রা-ভাই) বাড়ি গিয়ে উঠেছিলাম
তাদের দেড় বছরের ফুটফুটে ছেলেটির নানা কান্ডকারখানা | তার ভালোনাম একাংশ, ডাকনাম
ইমো | আধো-আধো দু’একটা কথা বলতে পারে, যদিও বোঝে প্রায় সব কিছুই | ইমোকে নিয়েই
আমাদের প্রায় সারাদিন কেটে যেত | ইমোকে কোনো জিনিস ভালো করে বুঝিয়ে তারপর যদি
প্রশ্ন করা হয় সে বুঝেছে কিনা, ইমো বিশাল বিজ্ঞের মতো গম্ভীর মুখে মাথাটা সামান্য
ঝুঁকিয়ে উত্তর দেয় ‘হুম’ | খেয়াল করে দেখেছি কোনো জিনিস না বুঝলে ইমো চুপ করে
থাকে, কিন্তু কখনোই ওই সম্মতিসূচক ‘হুম’ উত্তরটা দেয় না | আর যদি জিজ্ঞাসা করা হয়
“ইমো, তুমি বিয়ে করবে ?” ইমো উত্তর দেয় ‘হুম’ | এরপর যদি ইমোকে জিজ্ঞাসা করা হয়
“ইমো, তুমি বউকে কি করবে ?” ইমো চুক করে একটা চুমু দেখিয়ে দেয় !! বোঝো কান্ড !
(চিত্র : শুধুমাত্র প্লেটভর্তি গলৌটি কাবাবের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত, বাকি সমস্ত ফটোর সত্ত্ব লেখকের )
পুনশ্চঃ: এই ব্লগের অন্যান্য পোস্ট পড়তে সূচিপত্রে ক্লিক করুন |
দস্তরখোয়ান’ রেস্তোরার বিরিয়ানি-কাবাব খেয়েছি , তবে সে স্বাদ এখন মনে নেই | পুনরুদ্ধারে যেতে হবে একবার | তোমাদের একটা সুবিধা এই হয়েছে যে রাত্রের বা ভোরবেলার লাখনৌ-টাও পেয়েছ | ভালই ঘুরেছ |
ReplyDeleteতোর কানপুর থেকে তো কাছেই, তুই তো যেকোনো সপ্তাহান্তে ঘুরে আসতে পারবি | আমাদের তো সে উপায় নেই, এ জীবনে আর কখনো ওখানে বসে খেতে পারব কিনা জানি না !! আসলে এই দেশে এত ঘোরার জায়গা যে কোনো জায়গা রিপিট করার কোনো মানে হয়না | (বাঙালিদের পুরী বা দীঘা-প্রীতি কে এই হিসাবের বাইরেই রাখছি ) | ....... আর ভোর, সকাল, সন্ধ্যা, রাত - সবেরই লক্ষ্ণৌকে পেয়েছি কারণ আমরা প্রায় সপ্তাহখানেক ওখানে ছিলাম | তবুও অনেক ঘোরার ও খাবার জায়গা বাদ চলে গেছে |
Deleteপুরী , দিঘা এবং শান্তিনিকেতন | :D
Deleteএটাই হয় ..4 বছরে একবার ঘুরলাম | আর বাকি জীবনে হয়ত দুবার ঘুরতে আসবো যখন লখনৌ থেকে দুরে থাকব |
:)
Delete