Skip to main content

লক্ষ্ণৌ ডায়েরি : নবাব-কাবাব-আদাব-শবাবের শহরে কয়েকদিন (১২-১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ )


ভুলভুলাইয়া, বিরিয়ানি, টুন্ডে কাবাব, চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবী......

To-do লিস্টে এই কটা জিনিস ছিল মাস্ট | যেদিন ঠিক হয়েছে লক্ষ্ণৌ ঘুরতে যাব সেদিন থেকেই নামগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল | ঐতিহাসিক জায়গার প্রতি আমার আজন্ম দুর্বলতা | সেই সঙ্গে মোগলাই খাবারের দুর্নিবার হাতছানি | লোভনীয় কম্বিনেশন !!



আমাদের কলকাতার মতই লক্ষ্ণৌ শহরের অনেকগুলো রূপ | গোমতীনগর যেন সল্টলেক আর রাজারহাটের সংমিশ্রন, হজরতগঞ্জ যেন পার্কস্ট্রিট, আমিনাবাদ যেন খিদিরপুর | একদিকে শহরের  শতাব্দী প্রাচীন সত্তা, অন্যদিকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ঝাঁ-চকচকে মেট্রোপলিটন হবার আপ্রাণ চেষ্টা | 



যে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম তারা থাকেন গোমতীনগরের এক বহুতল আবাসনে | ওদের  ফ্ল্যাটটা তিন তলায়  | সুসজ্জিত বিশাল ফ্ল্যাট |  জানলা খুললে আকাশ দেখা যায় না, চারদিকের বিশাল বিশাল বাড়িতে ঢাকা পড়েছে আকাশের নীল রং | তবে এগারো তলা বাড়ির ছাদে উঠলে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায় |


স্থানীয় লোকেদের ভাষায় লক্ষ্ণৌ হল নবাব, কাবাব, আদাব আর শবাব-এর শহর | কথাটা ভুল নয় | শহরটা জুড়ে বেশ একটা নবাব নবাব গন্ধ | নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে ভুলভুয়াইয়ার থেকেও বড়া ইমামবাড়ার ছাদটা আমার অনেক বেশি ভালো লেগেছে | গোধূলিবেলার মায়াবী আলোয় ওখান থেকে লক্ষ্ণৌ শহরটাকে ভারী সুন্দর দেখায় | এছাড়াও ছোটা ইমামবাড়া, রুমী দরওয়াজা, ঘন্টা ঘর, ব্রিটিশ রেসিডেন্সি, ছত্তর মঞ্জিল – সবেতেই ইতিহাস বাসা বেঁধে আছে |  

       ____________________________________________________________________________

      _____________________________________________________________________________

      ______________________________________________________________________________


লক্ষ্ণৌর কাবাব আর বিরিয়ানির নাম শুনলেই পেটুক বাঙালির জিভে জল চলে আসে | এখানকার নিজস্ব কাবাব টুন্ডে গলৌটি কাবাব খেতে পৌঁছে গেছিলাম আমিনাবাদ | যদিও এই টুন্ডে (গলৌটি) কাবাব জিনিসটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি | তবে গোমতীনগরের ‘দ্য মুঘলস দস্তরখোয়ান’ রেস্তোরার মাটন বিরিয়ানি আর মসালা চিকেন – এই দুটো পদ ছিল অনবদ্য |

‘আদাব’ শব্দের অর্থ সম্মান ও বিনম্রতা | লখনৌ শহরের মানুষের আতিথেয়তা নিয়ে অনেক মজাদার গল্প শুনেছি, যদিও সেসব চাক্ষুষ করার তেমন সৌভাগ্য বা সময় হয়নি এবার | তবে এই শহরের শবাব (সৌন্দর্য) মুগ্ধ করেছে আমাদের | শহরের যেটুকু জায়গা আমরা গাড়িতে চড়ে দেখেছি, তার থেকেও বেশি দেখেছি খোলা রিক্সায় চেপে ! বস্তুতঃ কোনো জায়গাকে ভালো করে ঘুরে দেখতে হলে রিক্সা নামক বাহনটির জুড়ি নেই, বাসে কিম্বা প্রাইভেট গাড়িতে সেই মজা নেই | পুরোনো এই শহরের জায়গায় জায়গায় সুদৃশ্য মসজিদ, দরগা, গম্বুজাকৃতি চুড়োযুক্ত নানা সরকারী প্রতিষ্ঠানের বাড়ি | চারবাগ রেল স্টেশনটিও মানানসই | আর আছে পুরো শহরজুড়ে একগুচ্ছ পার্ক | বেশ কয়েকটাকে বাইরে থেকে দেখলেও ঢুকেছি মাত্র একটায় – জনেশ্বর মিশ্র পার্কে | রাতের আলোয় বাইরে হেকে আলোয় ঝলমল আম্বেদকর পার্ক দেখে খুব ভালো লেগেছে, কিন্তু সময়াভাবের কারণে ওখানে ঢুকতে পারিনি | 


আগ্রায় গেলে অটোওয়ালারা যেমন হ্যান্ডিক্রাফ্টসের দোকানে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করে, সেরকম লক্ষ্ণৌ শহরের রিক্সাওয়ালারাও ‘চিকন ফ্যাক্টরী’ তে নিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে | ব্যাঙের ছাতার মত এই শহরের আনাচে-কানাচে রয়েছে চিকনের দোকান | দরাদরিতে পারদর্শী না হলে একদর-মার্কা দোকানে যাওয়াই শ্রেয় | আর কাবাব বিরিয়ানির ক্ষেত্রেও সতর্কতা নেওয়ার দরকার, কারণ একই নামের গুচ্ছের দোকান রয়েছে | মোদ্দা কথায়, চারদিকেই পাতা আছে জালিয়াতির ফাঁদ |

আমাদের লক্ষ্ণৌ যাত্রার সবচেয়ে মজাদার অভিজ্ঞতা হল যে দম্পতির  ( আমার শ্যালিকা ও ভায়রা-ভাই) বাড়ি গিয়ে উঠেছিলাম তাদের দেড় বছরের ফুটফুটে ছেলেটির নানা কান্ডকারখানা | তার ভালোনাম একাংশ, ডাকনাম ইমো | আধো-আধো দু’একটা কথা বলতে পারে, যদিও বোঝে প্রায় সব কিছুই | ইমোকে নিয়েই আমাদের প্রায় সারাদিন কেটে যেত | ইমোকে কোনো জিনিস ভালো করে বুঝিয়ে তারপর যদি প্রশ্ন করা হয় সে বুঝেছে কিনা, ইমো বিশাল বিজ্ঞের মতো গম্ভীর মুখে মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে উত্তর দেয় ‘হুম’ | খেয়াল করে দেখেছি কোনো জিনিস না বুঝলে ইমো চুপ করে থাকে, কিন্তু কখনোই ওই সম্মতিসূচক ‘হুম’ উত্তরটা দেয় না | আর যদি জিজ্ঞাসা করা হয় “ইমো, তুমি বিয়ে করবে ?” ইমো উত্তর দেয় ‘হুম’ | এরপর যদি ইমোকে জিজ্ঞাসা করা হয় “ইমো, তুমি বউকে কি করবে ?” ইমো চুক করে একটা চুমু দেখিয়ে দেয় !! বোঝো কান্ড ! 



(চিত্র : শুধুমাত্র প্লেটভর্তি গলৌটি কাবাবের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত, বাকি সমস্ত ফটোর সত্ত্ব লেখকের ) 

পুনশ্চঃ: এই ব্লগের অন্যান্য পোস্ট পড়তে সূচিপত্রে ক্লিক করুন |



Comments

  1. দস্তরখোয়ান’ রেস্তোরার বিরিয়ানি-কাবাব খেয়েছি , তবে সে স্বাদ এখন মনে নেই | পুনরুদ্ধারে যেতে হবে একবার | তোমাদের একটা সুবিধা এই হয়েছে যে রাত্রের বা ভোরবেলার লাখনৌ-টাও পেয়েছ | ভালই ঘুরেছ |

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোর কানপুর থেকে তো কাছেই, তুই তো যেকোনো সপ্তাহান্তে ঘুরে আসতে পারবি | আমাদের তো সে উপায় নেই, এ জীবনে আর কখনো ওখানে বসে খেতে পারব কিনা জানি না !! আসলে এই দেশে এত ঘোরার জায়গা যে কোনো জায়গা রিপিট করার কোনো মানে হয়না | (বাঙালিদের পুরী বা দীঘা-প্রীতি কে এই হিসাবের বাইরেই রাখছি ) | ....... আর ভোর, সকাল, সন্ধ্যা, রাত - সবেরই লক্ষ্ণৌকে পেয়েছি কারণ আমরা প্রায় সপ্তাহখানেক ওখানে ছিলাম | তবুও অনেক ঘোরার ও খাবার জায়গা বাদ চলে গেছে |

      Delete
    2. পুরী , দিঘা এবং শান্তিনিকেতন | :D
      এটাই হয় ..4 বছরে একবার ঘুরলাম | আর বাকি জীবনে হয়ত দুবার ঘুরতে আসবো যখন লখনৌ থেকে দুরে থাকব |

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...