নরেন্দ্রপুর
রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট
ছড়াটা -
“নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময়,
খাদ্য
আলুময়,
চিন্তা
ব্রহ্মময় |”
অনেকদিন
আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই, কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে |
************************************************************
প্রথম
ভাগ : ঘন্টা
বাস্তবিকই
আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত | ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো, তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত, সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ, ‘lights out’এর ঘন্টাধ্বনি শুনে | চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা, প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা, স্কুলে যাবার ঘন্টা, হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা, খেলতে যাবার ঘন্টা, রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ
ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত |
প্রতিদিন
এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন
ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো, এদের বলা হতো ‘Time keeper’ |
মিশনে
আমাদের প্রত্যেকেরই প্রতিমাসে কোনো না কোনো ডিউটি পড়ত | যেমন ডাইনিং হলে খাবার পরিবেশন, 'প্রেয়ার হল' পরিষ্কার করা এবং সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, ডাইনিং হলে খাবার পর প্রত্যেকের থালা-গ্লাস ধোয়া
ঠিকঠাক হল কিনা তা দেখা, রবিবার হস্টেলের চারিদিকের আগাছা-জঞ্জাল পরিষ্কার করা, হোস্টেলের প্রত্যেকটা ঘর প্রতিদিন ঠিকঠাক করে পরিষ্কার করা হচ্ছে কিনা
তার তদারক করা, এমনকি বাথরুম
পর্যন্ত পরিষ্কার করা !! কিন্তু এই টাইম-কিপার দের কাজ ছিলো সবথেকে কঠিন, ঘন্টা বাজাতে এক মিনিট দেরী হলেই শুনতে হতো বকাঝকা | তবে এই টাইম-কিপার দের
স্কুল বা ডাইনিং হলে কোনো ঘন্টা বাজাতে হতো না, সেসবের জন্য লোক নিযুক্ত থাকত |
সারাদিনের
এই অসংখ্য ঘন্টানিনাদের মধ্যে সকাল বেলার ঘুমভাঙানি ঘন্টাধ্বনি আমাদের কাছে ছিল
সবচেয়ে অপছন্দের আর যেদিন ডিনারে মাংস থাকত (সাধারনত: শনিবার) সেদিনের ‘ডাইনিং
বেল’টা ছিলো আমাদের কাছে ছিল সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর |
![]() |
ডাইনিং হলের সামনে ঝোলানো সেই
ঘন্টা – যেটা পিটিয়েই আমাদের জানানো হত যে খাওয়ার সময় হয়েছে [চিত্রঋণ – শাশ্বত (রায়)দা]
|
***********************************************************
দ্বিতীয়
ভাগ : আলু
বাস্তবিকই
মিশনের হোস্টেলের সব রান্নাতেই থাকত আলুর জয়জয়কার | আমাদের পরমপ্রিয় এক মহারাজ, জুনিয়র-সেকশনের তপনদা, স্বামী আদিজানান্দ, প্রায়ই বলতেন ‘হস্টেলেও থাকবে আর আলু-ও খাবেনা, তা কি হয় !!” | এই কথা বলে বলে তিনি আমাদের সকলকে জোর করে যে কত আলু খাইয়েছেন তার
হিসাব নেই | আমাদের এক
প্রণম্য মাস্টারমশাই, জীবন বিজ্ঞানের অজিতদা, প্রয়াত শ্রী অজিত কুমার সেনগুপ্ত, বলতেন যে মিশনের খাবারের প্রেক্ষিতে আলু হল ‘ভগবান’ কারণ সবেতেই সে
বিরাজমান !
নরেন্দ্রপুরীয়
আলুর স্মৃতিতে প্রথমেই চোখে ভেসে ওঠে প্রতি সপ্তাহের সোমবার প্রাতঃরাশে পরোটার সাথে
দেওয়া আলুর তরকারীর কথা | সে তরকারিতে যেন জাদু মিশে থাকত | দেখতে অতি নিরীহ সেই
তরকারী মুখে দিলে মনে হত যেন অমৃত আস্বাদন করছি | জীবনে ওই স্বাদ আর কখনো পাইনি | বোধহয় আলুর সাথে মশলাপাতি
ছাড়াও পাচক ভালবাসা মিশিয়ে দিতেন | না হলে ওই জিনিস হয় না |
![]() |
এই
সেই বিখ্যাত আলুর তরকারী [চিত্রঋণ – সুদীপ
(পালিত)দা ]
|
শনিবার রাতে পাওয়া মাংসের ঝোলের আলুও ছিল অনবদ্য | হোস্টেল তো আর বাড়ি নয়, ফলে মাংস সেখানে ইচ্ছামতো পাওয়া যেত না | ওই ছোট-মাঝারি মিলিয়ে চার টুকরোই বরাদ্দ ছিল সবার জন্য | তবে সুখের বিষয় হল ঝোল আর আলু চাইলেই পাওয়া যেত | ওই দুটো জিনিস দিয়েই আমরা হাতার পর হাতা ভাত খেয়ে নিতাম |
আমাদের স্কুলে বিকালে খেলতে
যাওয়ার আগে কিছু হাল্কা স্ন্যাকস দেওয়া হত যাকে ওখানকার ভাষায় ‘light tiffin’ বলা হত | খেলা থেকে
ফেরার পর সন্ধ্যার জলখাবার দেওয়া হত, যার নাম ছিল ‘heavy tiffin’ | আমরা যখন ক্লাস নাইনে
উঠেছি,
সেটা 2000 সাল, তখন থেকে বিকালে সপ্তাহে
একদিন ‘লাইট টিফিন’ হিসাবে ফুচকা দেওয়া শুরু হয়, সেদিনই 'হেভি টিফিন'য়ে থাকত চপ-মুড়ি | ওই দিনগুলোতে আমরা কয়েকজন খেলা থেকে ফিরে খুব
তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে, ‘হেভি টিফিনে’র বেল পড়ার আগেই ডাইনিং হল গিয়ে হাজির হতাম | আসলে প্রতিদিনই ফুচকার কিছুটা আলুমাখা উদ্বৃত্ত থাকত, সেটা দিয়ে মুড়ি মেখে খেতে বড় ভালো লাগত | কিন্তু জিনিসটা খুব বেশি পরিমানে থাকত না, মানে প্রথম মাত্র নয়-দশ জনই সেটা পেত, সেজন্যই আগেভাগে দৌড়ে ডাইনিং হল যাওয়া |
![]() |
বিকালের ফুচকার আসর ( বাঁ-দিকের ফটোতেই দেখা যাচ্ছে সেই বিখ্যাত আলুমাখা )
|
ক্লাস
ইলেভেনে ওঠার পর আমরা নরেন্দ্রপুর কলেজে চলে গেলাম, কারণ আমাদের সময়ে H.S. সেকশন কলেজের অন্তর্ভুক্ত ছিল | সেসময় সপ্তাহে একদিন ডিনারে আলুরদম দেওয়া হত | আমরা কয়েকজন খাওয়াশেষে আরো কিছুটা আলুরদম একটা
গ্লাসে করে নিয়ে আসতাম | গভীর রাতে যখন খুব খিদে পেত, তখন ওই আলুরদমটা মুড়ি সহযোগে খেতাম | সেই স্বাদও ভোলার নয় |
![]() |
আলুর পাহাড় - নরেন্দ্রপুর মিশনে ‘নরনারায়ণ
সেবা’র রান্নার প্রস্তুতি [চিত্রঋণ – বিশ্বনাথ মহারাজ]
|
*********************************************************
তৃতীয়
ভাগ - ব্রহ্ম
মিশনে
ঢুকে প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা শুনলাম ‘ব্রহ্ম’ শব্দটা | আমরা এর আগে প্রজাপতি ‘ব্রহ্মা’র নাম শুনেছি, তাঁর সমন্ধে নানা পৌরানিক গল্প পড়েছি, এমনকি নানা টিভি সিরিয়ালে তাঁকে চাক্ষুষ পর্যন্ত করেছি | কিন্তু ‘ব্রহ্ম’ নামটা এর আগে কোনদিন শুনিনি | অথচ এখানে এসে শুনছি ব্রহ্ম নাকি সর্বত্র
বিরাজমান | দুবেলা
খাওয়ার আগে এই ‘ব্রহ্ম’কে নিবেদন করেই আমরা খাওয়া শুরু করছি | মহারাজরা বলছেন যে ব্রহ্মজ্ঞান হল আসল জ্ঞান | কিন্তু কে এই ‘ব্রহ্ম’ ? তিনি নাকি নিরাকার, ফলে তাঁকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু নাকি অনুভব করতে হয় !! এইসব কঠিন কথা তখন আমাদের মাথায় মোটেও
ঢুকত না | ক্লাস ফাইভ-সিক্সের
বাচ্চা এসব জিনিস কী করেই বা বুঝবে !!
জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক অজিতদা ‘ব্রহ্ম’কে খুব মজাদার ভাবে ব্যাখা করেছিলেন | একেবারে বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম মেনে | ক্লাস এইটে আমাদের তিনি বলেছিলেন, “বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে তোরা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা কে দেখেছিস - তিন মাথা ওয়ালা, মুখে সাদা দাড়ি - রীতিমতো আকার, আয়তন যুক্ত | এবার ‘ব্রহ্মা’ বানান থেকে আ-কার টা বাদ দিয়ে দে, কি পড়ে থাকল ? ‘ব্রহ্ম’ তো ? ফলে ব্রহ্ম ‘নিরাকার’ ! বুঝতে পেরেছিস তো ? ব্রহ্মা হলেন সাকার আর ব্রহ্ম হলেন নিরাকার |”
মিশনে সকাল-বিকাল দুইবেলা আমাদের মন কলুষমুক্ত করতে ভগবান-আরাধনার ব্যবস্থা ছিল | ধুতি-পাঞ্জাবী পরে আমরা প্রার্থনাকক্ষে যেতাম এবং সাধ্যমত বেসুরো গলায় খানিকটা গান গাইতাম আর শেষের দিকটায় খানিকটা ঘুমিয়ে নিতাম | কেউ কেউ আবার পাঞ্জাবী-উত্তরীয়র আঁড়ালে গল্পের বই নিয়ে যেত, আমাদের এক বন্ধু তো গোটা হ্যারি পটার সিরিজ আর সিডনি সেলডনের গোটা দশেক বই প্রেয়ার হলে বসেই পড়ে শেষ করলো |
জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক অজিতদা ‘ব্রহ্ম’কে খুব মজাদার ভাবে ব্যাখা করেছিলেন | একেবারে বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম মেনে | ক্লাস এইটে আমাদের তিনি বলেছিলেন, “বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে তোরা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা কে দেখেছিস - তিন মাথা ওয়ালা, মুখে সাদা দাড়ি - রীতিমতো আকার, আয়তন যুক্ত | এবার ‘ব্রহ্মা’ বানান থেকে আ-কার টা বাদ দিয়ে দে, কি পড়ে থাকল ? ‘ব্রহ্ম’ তো ? ফলে ব্রহ্ম ‘নিরাকার’ ! বুঝতে পেরেছিস তো ? ব্রহ্মা হলেন সাকার আর ব্রহ্ম হলেন নিরাকার |”
মিশনে সকাল-বিকাল দুইবেলা আমাদের মন কলুষমুক্ত করতে ভগবান-আরাধনার ব্যবস্থা ছিল | ধুতি-পাঞ্জাবী পরে আমরা প্রার্থনাকক্ষে যেতাম এবং সাধ্যমত বেসুরো গলায় খানিকটা গান গাইতাম আর শেষের দিকটায় খানিকটা ঘুমিয়ে নিতাম | কেউ কেউ আবার পাঞ্জাবী-উত্তরীয়র আঁড়ালে গল্পের বই নিয়ে যেত, আমাদের এক বন্ধু তো গোটা হ্যারি পটার সিরিজ আর সিডনি সেলডনের গোটা দশেক বই প্রেয়ার হলে বসেই পড়ে শেষ করলো |
সকাল-সন্ধ্যের
এই আধ্যাত্মিক অভ্যাসের ফলে আমরা হোস্টেলের ঘরে বসে যে ঈশ্বর বা ব্রহ্ম নিয়ে
আলোচনা করতাম তা একেবারেই নয়, তবে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করতে খুব সুবিধা হতো | আরেকটা সুবিধা হল- পরবর্তীকালে নানারকম
পূজা-পার্বণ বা অনুষ্ঠানের সময় ধুতি পরতে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না |
তবে
সন্ধ্যার প্রার্থনা কক্ষে “খন্ডন ভব” গানটা কিন্তু আমাদের অনুভূতির এক বিশেষ স্তরে
উন্নীত হয়ে রয়েছে | আমাদের প্রত্যেক প্রাক্তনীর মনেই নরেন্দ্রপুর মিশন নিয়ে একটি আলাদা
জায়গা সযত্নে বরাদ্দ করে রাখা আছে, এই গানটা সেখানকার সবথেকে জোরালো অনুভূতিগুলোর একটা | আজও যদি কখনো সন্ধ্যাবেলায় টিভি-রেডিও-মাইক থেকে
‘খন্ডন-ভব-বন্দন’ গানটা কানে আসে তাহলে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি, মনটা আজ থেকে ১৫-১৬ বছর আগের কোনো এক
সন্ধ্যাবেলায় ফিরে যায় | স্পষ্ট দেখতে পাই, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে সেই ছোট্ট-আমি বন্ধুদের মাঝে প্রেয়ার হলে বসে
আছি ||
(সমাপ্ত)
পুনশ্চঃ : নরেন্দ্রপুর সংক্রান্ত আমার বাকি লেখাগুলো একসঙ্গে পরপর পড়া যাবে এখানে : নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা
অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি
অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি
প্রথম
লেখা : 17-02-2015
পরিমার্জন
: 27-12-2016
Very nicely written.
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ ||
Deleteখুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ | পাঠকের ভালোলাগাতেই লেখকের পরিশ্রম সার্থক ||
DeleteSotti Asadharon lekha ta
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ | তোমাদের ভালোলাগাই আমার লেখার প্রেরণা | ভালো থেকো |
Deletevalo likhechis
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ |
DeleteArghya khub bhalo likhechhis. Koyekta porlam. Proti ta kothai narendrapur ke abar mone poralo.
ReplyDeleteSoumyajyoti Da 1995 batch.
পাঠকের প্রশংসার চেয়ে বড় প্রাপ্তি লেখকের কাছে আর কিছুই হতে পারে না | অনেক ধন্যবাদ তোমাকে | ভালো থেকো দাদা |
DeleteDurdanto... Abar chotto belata chokher samne choke elo....
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ | ভালো থেকো ||
DeleteLekhata pore ekabr youtube-e "Khandano bhava bandono" shune nilam
ReplyDeleteহাঃ হাঃ !! ভালো করেছিস | আমি তো ডাউনলোড করে মোবাইল আর কম্প্যুটার - দু'জায়গাতেই রেখে দিয়েছি | পিছুটানে মন আক্রান্ত হলেই টুক করে গানটা একবার শুনে নিই ||
Deletebhishon bhalo likhechis arghya.... chamatkar!
ReplyDeleteতোদের (পাঠকদের) পড়ে ভালোলাগলেই আমি খুশি || :) :) এই ব্লগের বাকি লেখাগুলোও সময় করে মাঝেমধ্যে দু'একটা পড়ে দেখিস |
Deletemone juriye dili bhai ... ki bhalo likhis maairi !
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ | যখন ভালো লেগেছে তাহলে অনুরোধ করব বাকি লেখাগুলো পড়বার জন্য | যদিও ফেসবুকেও সব লেখাই সময়ে সময়ে দিয়েছি, তবু এখানে অনেক বেশি systemic way-তে লেখাগুলো সাজানো আছে |
Deleteki6u jana gelo. valo information. Dhonyobad
ReplyDeleteআপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম | অনেক ধন্যবাদ | একটা অনুরোধ - এই ব্লগের বাকি লেখাগুলোও সময় পেলে পড়ে দেখবেন |
Delete