Skip to main content

রথের ছোটবেলা




ছোটবেলায় রথের দিন খুব আনন্দ হত | আগের দিন সন্ধ্যাবেলা বাবার সাথে বাজারে গিয়ে একখান রথ কিনে আনা হত | বয়স অনুযায়ী রথের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটত | একেবারে ছোটবেলায় জুটত একতলা রথ | কয়েক বছর পর পেলাম দোতলা রথ, আর পরে তিনতলা |

রথের দিন সকাল থেকেই মহা উৎসাহে রথ সাজানো শুরু করতাম | দোকান থেকে রঙিন কাগজ (মার্বেল পেপার) আর সেলোফিন পেপার কিনে আনা হত, মা আটা দিয়ে আঁঠা বানিয়ে দিত | প্রথমে রথের প্রতি তলার তিনদিক রঙিন কাগজে মুড়ে দিতাম, শুধু সামনের দিক ফাঁকা থাকত | এরপর বাকি কাগজ দিয়ে সাধ্যমতো নকশা বানিয়ে রথের গায়ে আটকে দিতাম | কখনো পাতাবাহার গাছের পাতা ছিঁড়ে সেগুলো রথের থামের সাথে আটকে দিতাম |

রথ সাজানো শেষ হলে একেবারে নিচের তলার ভেতরে ঠাকুর সাজানো হত | রথ চলাকালীন ঠাকুর যাতে মুখ থুবড়ে না পরে যায় সেজন্য মূর্তিকে রথের থামের সাথে বেঁধে দেওয়া হত | ঠাকুরের সামনে ছোট স্টিলের প্লেট, সেখানে শোভা পাবে বাতাসা আর নকুলদানা |

এই রথ সাজাতেই দুপুর গড়িয়ে যেত | মাঝে হাতে চলে আসত পাঁপড় ভাজা | তারমধ্যেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম যে বৃষ্টি নেমেছে | রথের দিন হলে বৃষ্টি আসবেই – এই ধারণা মনে বদ্ধমূল ছিল | এক বছর রথের দিন বৃষ্টি হল না, খুব অবাক হয়েছিলাম তখন |

এরপর বিকালবেলায় টুকুর টুকুর করে মা, বাবা বা পিসিকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় রথ টানতে বেরোতাম | বেশ একটা প্রতিযোগিতা গোছের ব্যাপার হত – কার রথ কত বড়, কার রথ কত ভালো করে সাজানো ! সেই সঙ্গে থাকত ধর্মীয় ট্যাক্স আদায়, রাস্তায় পরিচিত বা অপরিচিত যেকোনো কাউকে ধরে একটা বাতাসা বা একটা নকুলদানা ধরিয়ে দেওয়া আর তার বদলে কিছু পয়সা দাবী করা |

তারপর একদিন বড় হয়ে গেলাম, রথ নিয়ে খেলা বন্ধ হয়ে গেল | প্রথম যেবার রথ কিনলাম না সেবার একটু অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল, পরের বছর থেকে ব্যাপারটা সয়ে গেল | ছোটবেলার নানা ভালোলাগা পরে বড় হয়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে - এই রথ-পর্বও সেরকম হয়ে গেল | দুঃখের ব্যাপার সেসময় ডিজি-ক্যাম বলে কোনো বস্তু আমাদের ছিল না, না ছিল মোবাইল ফোন | সেই সময় ক্যামেরা থাকলেও শুধু রথযাত্রা উপলক্ষ্যে ক্যামেরায় ‘রিল’ ভরানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল | ফলে ছোটবেলার সেই রথযাত্রার বিশাল কর্মকান্ডের কোনো ফটো এখানে দিতে পারলাম না | মাথায় ডেটা-কেবল গুঁজে যদি ফটো আদানপ্রদানের ব্যবস্থা থাকত তাহলে অবশ্য অনেকগুলো ফটোই এখানে দেওয়া যেত - ছবিগুলো মনের মধ্যে ভাসছে, একদম স্পষ্টভাবে |

© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, 25-06-2016


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...