'উৎকণ্ঠা'
বস্তুটি সাধারণ মানবজীবনে মোটেও ভালো নয় | নানারকম শারীরিক ব্যাধি ডেকে আনে এটি | কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই জিনিসটা
উপভোগ্যও বটে |
যেমন ধরা যাক - আপনি
ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছেন | যদি সেখানে "কে জিতবে ?" , "লাস্ট ওভারে পনেরো রান উঠবে তো ?",
"অমুকের সেঞ্চুরিটা ফসকে যাবে না তো
? " এইসব
উৎকণ্ঠাগুলোই না থাকে, তাহলে নিজের দল জিতলেও সেই "খেলা দেখার আনন্দ"টা থাকে না |
সেরকমই ধরা যাক আপনি
ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস পড়ছেন কিম্বা Thriller movie দেখছেন, সেখানে যদি আগে থেকে climax sceneটি আপনার জানা থাকে,
তাহলে সেই গল্প পড়া বা সিনেমা দেখাটা খুব
একটা উপভোগ্য হয় না | "এরপর কী হবে" গোছের উত্তেজনায় বুক দুরুদুরু করাটাই Thriller
গল্প-সিনেমার আসল মজা | সেটুকু না হলে ও জিনিস 'জোলো' |
এবার আসি আসল প্রসঙ্গে
- আমাদের চারপাশে কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁদের অভ্যাসই হলো এই 'উৎকণ্ঠার' মজা নেওয়া থেকে অন্যকে বঞ্চিত করা | আপনি যে গল্পটি পড়ছেন বা সিনেমাটি দেখছেন
সেটি যদি ওই ব্যক্তির আগে পড়া বা দেখা হয়ে থাকে তাহলে অবধারিতভাবে তিনি আপনাকে
শুরুতেই বলে দেবেন কাহিনীর আসল twist বা climaxটি, আপনি জিজ্ঞাসা করা না সত্ত্বেও | ফলে আপনার গল্প পড়ার বা সিনেমা দেখবার মজাটাই অর্ধেক হয়ে
যাবে | এই প্রসঙ্গে নিজের
জীবন থেকে দু'তিনটে
উদাহরণ দিচ্ছি -
১) তখন গোয়ালীয়রে একটি
বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করি | আমির খান, করিনা কাপুর অভিনীত 'Talaash' ছবিটি রিলিজ করেছে | একদিন বিকালে সিনেমাটা হলে দেখতে যাব,
দুপুরবেলায় খাওয়ার টেবিলে বসে কী এক প্রসঙ্গে
এক ছাত্রকে ব্যাপারটা বলেছি , সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র বলে উঠলো, "ও..আপনি Talaash দেখতে যাচ্ছেন !! দারুণ সিনেমা | climax সিন দেখার আগে অব্দি
বুঝতেই পারবেন যে করিনা কাপুর হলো ভূত !"
আপনি ভাবুন,
এই কথা বলে দেওয়ার পর ওই সিনেমা দেখার মজা
থাকে !!
২) তখন স্কুলে পড়ি | একদিন সত্যজিত রায়ের "রয়েল বেঙ্গল
রহস্য" বইটা সদ্য লাইব্রেরি থেকে তুলেছি | তখনো আমি ব্যোমকেশ পড়া শুরু করিনি,
সে সময়ে আমি die hard ফেলুদা-ফ্যান, ফেলুদার গল্পের সাসপেন্স আমাকে মারাত্মক টানে | বইটা হাতে নিয়ে ক্লাসে
যাচ্ছি, এক লাইনও পড়া শুরু
করিনি, এমন সময়ে এক বন্ধু
(নামটা এখানে লিখছি না) হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, "আরে অর্ঘ্য ! এই বইটা তুলেছিস | খুব ভালো গল্পটা,
আমার পড়া, দেখবি মহীতোষ বাবু নয়, আসল শিকারী শশাঙ্ক বাবু | আর খুনটা কেউ করেনি,
লোকটা বাজ পড়ে মারা গিয়েছিল |"
বুঝুন কান্ড !! প্লট
জমে ওঠা তো দূরের কথা, শুরুই হতে পারল না, তার আগেই ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে গেল |
৩) শেষ উদাহরণ হল আমার
এক বন্ধু, নাম বিবেক মিশ্র | ও আগে দেখে ফেলেছে এমন কোনো thriller
সিনেমা ওর পাশে বসে আপনি ল্যাপটপে দেখতেই
পারবেন না | প্রতি
পাঁচ মিনিট পরপর বলে দেবে যে আগামী sceneগুলোতে কী কী ঘটতে চলেছে |
যেমন,
একদিন প্রকাশ ঝাঁ পরিচালিত,
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত "Jai
Gangaajal" সিনেমাটা ওর সামনে
দেখার ভুল করেছিলাম | যাইহোক, সিনেমা
চলছে আর পাশে বিবেকের কমেন্ট্রি চলছে | ...........ভিলেন একটা বাচ্চাকে খুন করবে বলে বেরিয়েছে,
এদিকে বাচ্চাটা কোথাও লুকিয়ে রয়েছে,
টানটান উত্তেজনার মুহূর্ত,
এমন সময়ে বিবেক বলে উঠলো,
"এই বদমাশটা বাচ্চাটাকে খুঁজে পেয়ে
যাবে, কিন্তু মেরে ফেলতে
পারবে না, পুলিশ এসে শেষ
মুহুর্তে ওকে বাঁচিয়ে নেবে ".... এরপর এক জায়গায় জনতা ক্ষেপে গিয়ে
সমাজবিরোধীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে, বিবেক বলল, "এবার ওরা অমুক অমুককে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেবে"
......... মাঝেমাঝে আবার বিবেক আমাকে বলছে, "এরপর তেমন কিছু নেই |
দাঁড়া, আমি তোকে আসল সিনগুলো দেখাচ্ছি |"
এই বলে সিনেমাটাকে 'ফরওয়ার্ড' করে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়,
আমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই !! তারপর
ওখানে দাঁড় করিয়েও আমাকে বলে দিতে থাকে যে আগামী সিন গুলোতে আমি কী কী দেখতে চলেছি | সেদিন আমি এতটাই
বিরক্ত হয়ে গেছিলাম যে ওকে একবারও বাধা পর্যন্ত দিইনি |
কিন্তু তারপর থেকে
কোনো সিনেমা একসাথে দেখতে হলে আগে শুনে নিই যে ওটা ও আগে দেখেছে কি না | যদি না দেখে থাকে তো ভালো,
নাহলে রীতিমতো হুমকি দিয়ে রাখি যে যদি একটা ও
লাইনও বলে দেয় তাহলে 'খুব খারাপ হবে" | বিবেক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় |
ওর 'আগে-দেখা' কোনো সিনেমা চালালে এখন প্রথম আধ ঘন্টা ভালই কাটে | আমার হুঁশিয়ারীর কথা মাথায় রেখে একদম মুখ
বন্ধ করে রাখে ও | কিন্তু যত সিনেমা এগোতে থাকে, ওর মধ্যে কিরকম একটা ছটফটানি ভাব শুরু হয় | অনেক কথা না বলার যন্ত্রণা ওকে মনের ভিতরে
কুরে কুরে খায় যেন | ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারি এভাবে মনকে দমিয়ে রাখতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে
ওকে | তাই আমি আবার
সাবধানবাণীটা 'রিপিট'
করে দিই, যাতে মুখ ফস্কে কিছু বলে না ফেলে | এভাবেই চলতে থাকে আমাদের সিনেমা দেখা |
পুনশ্চঃ -- আমার বোন
তোর্সা আবার আরেক কাঠি উপরে | কোনো থ্রিলার সিনেমা চালিয়েছি কম্প্যুটারে,
আমরা কয়েকজন মিলে দেখছি,
ধরা যাক আমার আগেই সিনেমাটা একবার দেখা | উৎকণ্ঠার পারদ চড়তে চড়তে একটা জায়গায় পৌছানোর
পর সেটা আর তোর্সা নিতে পারে না | চোখ গোলগোল করে তোর্সা আমায় জিজ্ঞাসা করতে থাকে,
"দাদা,
এরপর কী হবে ?" আমি চুপ | তোর্সা আবার প্রশ্ন করে | এবার আমি উত্তর দিই,
"কথা না বলে দেখতে থাক" | তোর্সা নাছোড়বান্দা,
"দাদা,
বল না, এরপর কী হবে !" শেষে আমি বলি,
"আচ্ছা,
তাহলে সিনেমাটা বরং বন্ধ করে দিই | তারপর তোকে বলে দিচ্ছি যে এরপর কী হবে | সব যদি বলেই দেব তাহলে সিনেমার বাকিটা দেখে
তোর লাভ কী ?" .. অতঃপর
তোর্সা চুপ করে পুনরায় সিনেমাতে মনোনিবেশ করে |
© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি,
দুর্গানগর, 13-01-2017
Comments
Post a Comment