(1) ঘুম ভাঙা
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে
আমাদের রোববারগুলো ছিল বেশ কর্মমুখর, সেখানে আলসেমির খুব একটা জায়গা ছিল না | সেই
সাতসকালেই উঠতে হতো ঘুম থেকে, সপ্তাহের বাকি ছ'দিনের তুলনায় মাত্র পনেরো মিনিট বেশি ঘুমাতে
পারতাম আমরা ঐদিন | যেমন এই শীতের সময়ে সপ্তাহের বাকি দিন ঘুম থেকে উঠতে হয় সকাল
সাড়ে পাঁচটায়, আর রবিবার পৌনে ছ’টা অবধি ঘুমানো যায় | রবিবারের প্রেক্ষিতে ঐ পনেরো
মিনিটের ছাড়টুকুই পর্যাপ্ত বলে মনে করেন মিশন কর্তৃপক্ষ | ঘুমের লেজ-স্বরূপ বিছানায়
বসে লেপজড়ানো আলস্যের কোনো জায়গা নেই সেখানে, একে তো ঢং ঢং করে ঘন্টা (rising
bell) বেজে চলে আর সেই সাথে শুরু হয়ে যায় হোস্টেলের স্যার-মহারাজদের রাউন্ড দেওয়ার
পালা | তাছাড়া ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে ডাইনিং হল, প্রেয়ার হল ইত্যাদি জায়গায় যেতে
দেরী হয়ে যাবে, তখন সেই সবের জন্য জুটতে পারে শাস্তির ধাক্কা !
(2) হট ড্রিংক :
ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজা, প্রাতঃকৃত্য
ইত্যাদি সম্পন্ন করে পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের পৌঁছতে হত ডাইনিং হলে, সেখানে ‘হট
ড্রিংক’ হিসাবে মিলত দুধ, হরলিক্স কিম্বা চা | সঙ্গে কেক, বিস্কুট ইত্যাদি | তবে
কোনো কোনো দিন মৃত্যুদেব যমরাজের আবির্ভাব ঘটত ‘চিরতার জল’ রূপে | সেই জল খেলে
অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসার জোগাড় হত | মিশনের জীবনযাত্রার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য
হল যে ওখানে প্রায় কোনো কিছুই ঐচ্ছিক নয়, সবই আবশ্যিক | ফলে চা-হরলিক্সের পাশাপাশি
গোটা এক গ্লাস চিরতার জল পান করাও ছিল বাধ্যতামূলক | তবে কোনো কোনো সময় আমরা এই ‘হট ড্রিংক’
পর্বটি ‘বাংক’ করতাম, কিন্তু হোস্টেল কর্তৃপক্ষও বোকা নয়, এইরকম ‘বাংকিং’ গনহারে
চালু হলে দু-তিনদিনের মধ্যেই তাঁরা ‘অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম’ চালু করে দিতেন কখনো
কখনো | রীতিমতো রেজিস্টার নিয়ে কোনো স্যার বা মহারাজ (সন্ন্যাসী) বসে থাকতেন ডাইনিং হলে | তাঁদের সামনে শুধু গ্লাস ভরে হট ড্রিংক নিলেই হতো না, সেটা কয়েক চুমুকে খালি করে সেই ফাঁকা
গ্লাস তাঁদের দেখিয়ে তবে নিস্তার পাওয়া যেত | আর সেই রেজিস্টারে যারা অনুপস্থিত
থেকে যেত, তাদের জন্য দুপুরে খাওয়ার পর একপ্রস্থ বকাঝকা বা আধাঘন্টা কানধরে নিল-ডাউনের
ব্যবস্থা থাকত |
![]() |
ডাইনিং হল
|
(3) PT-হীন স্বস্তির মিনিট কুড়ি :
মিশনের হোস্টেল জীবনে আমাদের
সবথেকে বিভীষিকা ছিল সপ্তাহের ছ’দিন এই হট ড্রিংকের পর শরীরচর্চার পর্ব | রবিবারে
সেদিক থেকে আমরা ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ | ওই মিনিট কুড়ি আমরা ঘরে ফিরে আড্ডা দিতে পারতাম | ধীরে সুস্থে ধুতি পাঞ্জাবী পরে নিয়ে আমরা অপেক্ষা করতাম প্রেয়ার হলে যাওয়ার ‘বেল’এর
জন্য | মিশনের আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই ছিল ঘন্টা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত | এই
ঘন্টাধ্বনি শুনেই আমরা লেজ তুলে দৌড়ে হাজির হতাম কাঙ্ক্ষিত স্থানে |
(4) প্রার্থনা,
পড়াশুনা এবং প্রাতঃরাশ :
![]() |
প্রেয়ার হলে সামনে ছেলেরা বসে গান
গাইছে, পিছনে মহারাজ ও স্যারেরা বসে
|
সকালে প্রেয়ার করে আমরা হাজির
হতাম স্টাডিতে, সপ্তাহের বাকি ছ’দিনের মতোই | সেখানে পড়া বা পড়বার নাটক করে সময়
কাটাতাম | নিরীহ গোবেচারা গোছের স্যার স্টাডিহল সামলাবার দায়িত্বে থাকলে গল্প করা,
ঘুমানো, গল্পের বই পড়া সবই চলত বিনা বাধায় | অন্যদিকে কড়া স্যার থাকলে বকা, কানমলা,
কিল, চড়, ভবনের মহারাজের কাছে নালিশ কিছুই বাদ যেত না |
![]() |
স্টাডি
– এখানেই সবাইকে বসে একসাথে পড়াশুনা করতে হত
(চিত্রঋণ
– রিয়াজুল হক)
|
দেড় ঘন্টা পড়াশুনার পর সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা হাজির হতাম ডাইনিং হলে | রোববার আমাদের ব্রেকফাস্টটা বেশ
ভালো থাকত | আমাদের সময়ে ঐদিন সাধারনতঃ খিচুড়ি-পাঁপড়-পাতি লেবু কিম্বা ফ্যানাভাত-আলু
মাখা-ঘি দেওয়া হতো | মাঝে একবার এক বছর, তখন আমি ক্লাস নাইন, যোগানন্দ ভবনে থাকি,
শুরু হল পান্তা ভাত-কাঁচা পেয়াজ-লঙ্কা-আলু ভাজা | সেই খাবার তখন দারুণ ‘হিট’ হয়েছে,
এমন সময়ে আমাদের ভবনের মহারাজ (যোগানন্দ ভবনের নারায়ণ মহারাজ ওরফে নাড়ু মহারাজ)
ঘোষণা করলেন যে এই খাবার নাকি ‘তামসিক’, ফলে একে বন্ধ করতে হবে | এর ফলে এই পান্তা
ভাত বন্ধ হয়ে গেল | আমরা যার-পর-নাই ক্ষিপ্ত হলাম, কিন্তু মিশনে রাষ্ট্রতন্ত্রের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফলাফল ছিল অতি ভয়াবহ, ফলে মুখ বুজে এই ‘অন্যায়’ আমাদের সইতে হল
!
(5) ‘গ্র্যান্ড সাফাই’
ব্রেকফাস্ট পরবর্তী দেড়
ঘন্টা (সকাল ন’টা থেকে সাড়ে দশটা) ছিল আমাদের ‘ফ্রি-টাইম’ | এরপর সাড়ে দশটায় শুরু হত Grand Safai | ব্যাপারটা কিছুই না, খানিকটা বলা যেতে পারে সমাজবন্ধুদের ভূমিকায় নিজেদের
নিয়োগ করা | ভবনের (হোস্টেল) চারিদিকে ঝাঁট দেওয়া, পাতা কুড়িয়ে ডাস্টবিনিং করা, হোস্টেলের সামনের ‘লন’
পরিষ্কার করা, প্রেয়ার হলের বিশাল বিশাল কার্পেট ঝেড়ে
পরিষ্কার করা, বাথরুম পরিষ্কার করা ইত্যাদি | এই কাজের একটা ‘লিস্ট’ বের হতো, সেখানে প্রত্যেকের
নামের পাশে তাদের কী কী কাজ সেটা লেখা থাকত, সেই অনুযায়ী
আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হত | (তবে যে কোনো এক মাসের গ্র্যান্ড
সাফাইয়ের লিস্টে হোস্টেলের সবার নাম থাকত না, কিন্তু প্রত্যেকের নামই ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে পর্যায়ক্রমিক ভাবে আসত - আলাদা আলাদা মাসে )
![]() |
বাচ্চাদের সাথে মহারাজও হাত
লাগিয়েছেন সাফাইয়ে (চিত্রঋণ – বিশ্বনাথ মহারাজ)
|
(6) ‘গ্র্যান্ড সাফাই’য়ের আগের-পরের
সময় :
ব্রেকফাস্ট এর পর থেকে লাঞ্চ (দুপুর
বারোটায় শুরু) পর্যন্ত টাইম-গ্যাপের মধ্যে গ্র্যান্ড সাফাইয়ের সময়টুকু বাদ দিলে বাকি
সময়টা ছিল আমাদের রোববারের সেরা ‘টাইম-স্লট’ | এই সময়ে আমরা আক্ষরিক অর্থেই ছিলাম ‘মুক্ত’,
কোনো স্যার-মহারাজের শাসন থাকত না তখন | কখনো কখনো আমরা গ্র্যান্ড সাফাইয়ের কাজটা
একটু আগেই শুরু করে দিতাম, ফলে একটানা অনেকটা সময় ফাঁকা পাওয়া যেত লাঞ্চের আগে | এই সময়ে কেউ মাঠে খেলতে যেত, কেউ হোস্টেলে ক্যারম খেলত, কেউ টিভি রুমে যেত আবার কেউ
নিজের ঘরে ফিরে ‘ল্যাদ’ খেতে পারত | আমাদের সময়ে রবিবারে টিভিতে ‘Captain Vyom’,
‘শক্তিমান’, ‘বিরাট’ এই সমস্ত সিরিয়াল দেখতে দেওয়া হতো | সেযুগে সেই সব সিরিয়াল
নিয়ে আমাদের মনে দারুণ উত্তেজনা ছিল | সারা সপ্তাহে একদিনই আমরা টিভি দেখতে
পারতাম, তাও মাত্র ঐটুকু সময়ের জন্য !
(7) মধ্যাহ্নভোজনোত্তর পর্ব :
মিশনে এই লাঞ্চ পরবর্তী সময় ছিল দু’রকম
----
( a) Visiting Day :
সপ্তাহের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ
রবিবার ছিল ‘ভিসিটিং ডে’ অর্থাৎ ওই দিন আমাদের মা-বাবারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে
আসতেন, দুপুর দুটো থেকে পাঁচটা – এই তিন ঘন্টা ছিল এই মিলনক্ষণ | বাবা-মায়েদের
হোস্টেলের রুমে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, ফলে হোস্টেলের ডাইনিং হলের বারান্দা, ভবনের কোনো
খোলা ‘কমন স্পেস’, স্কুল বিল্ডিংয়ের বারান্দা, আমবাগান এবং সর্বোপরি পথে-ঘাটে-মাঠে
যেকোনো খালি জায়গাতেই ‘বেড-কভার’ বিছিয়ে আমরা বসতাম বাবা-মায়ের সাথে |
আমার কাছে এই ‘ভিসিটিং ডে’র সেরা
আকর্ষণ ছিল মায়ের রান্না করা খাবার | লুচি-মাংস, চিকেন-চাউমিন কিম্বা কোনদিন পাতি
মাংসভাত | পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা, শুকতারা বা অন্যান্য গল্পের বইও হাতে পেতাম এই
সময়ে | সেই সাথে ছিল মায়ের কোলে শুয়ে মায়ের করা পাখার বাতাসে একটু দিবানিদ্রা | পরীক্ষার
আগের দিন হলে মা-বাবার সামনে কখনো সখনো বই খুলেও বসেছি ওই সময়ে, আবার কখনো হয়ত হোমওয়ার্ক
করেছি ওই সময়ে বসে | এছাড়া, দু’সপ্তাহের নোংরা কাপড়-জামা এদিন মাকে দিয়ে দিতাম ,
আর হাতে পেতাম আরেক সেট – সামনের পনেরো দিন চালানোর জন্য | (হোস্টেলের লন্ড্রি-ব্যবস্থাকে
আমি কোনোদিনই ভরসা করতাম না, বাকি সব হোস্টেলের মতই এখানকার ধোপারাও ছিল উধোর কাপড়
বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ওস্তাদ; কাপড় ঠিকঠাক পরিষ্কারও হতো না - কোনো জামায় হয়ত
কালির দাগ লেগে ফিরে আসত কিম্বা কোনো প্যান্টের পকেট ছিঁড়ে !)
তবে সবার ভাগ্যে এত সুখ ছিল না ওই
সময়টাতে | আমাদের কয়েকজন বন্ধুর বাবা যেমন এসেই একদম মাস্টারি-কায়দায় ছেলের পড়া
নিতেন | কোনো পরীক্ষায় ছেলে একটু খারাপ করলেই সেই রেজাল্ট দেখে ছেলেকে যাচ্ছেতাই
ভাবে বকতেন | কেউ কেউ আবার ওই সুযোগে ছেলেকে উত্তম-মধ্যমও দিতেন | একজন বাবা তো
ছেলেকে প্রতি ভিসিটিং ডে-তেই বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বেদম প্রহার করতেন পড়া না করা, পরীক্ষায়
কম নম্বর পাওয়া ইত্যাদি অভিযোগে | আমরা দূর থেকে ছেলের চিৎকারের আওয়াজ শুনতাম | আবার প্রতি ব্যাচেই দু’তিনজন ছাত্রের অভিভাবক ছিলেন আরেক কাঠি উপরে – তাঁরা ভাড়া
করে ওই সময়ে ‘প্রাইভেট টিউটর’ নিয়ে আসতেন, ওই তিন ঘন্টা একনাগাড়ে ছেলেকে পড়িয়ে তাকে মহাপন্ডিত বানানোর অভিপ্রায় ছিল তাঁদের |
যেসব ছাত্রের বাড়ি একটু
বেশি দূরে তাদের অভিভাবকেরা প্রতি ভিসিটিং ডে-তে আসতে পারতেন না | এইসব ছাত্ররা
স্কুল ক্যাম্পাসের মধ্যে বসা ক্যাফেটেরিয়া থেকে খাবার কিনে নিয়ে সোজা চলে যেত
মাঠের দিকে, ঐদিন সারা দুপুর-বিকাল তারা খেলার সুযোগ পেত |
আমাদের স্কুলজীবন কেটেছে প্রাক-প্রযুক্তির যুগে | আমি 2004 সালে উচ্চ
মাধ্যমিক পাশ করেছি | orkut, facebook -এই দু'য়ের সেসময় সবে জন্ম হয়েছে, আর i-phone,
android, smartphone, whatsapp-ইতাদি জিনিস ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে
আছে, ওসবের নামও কেউ তখন শোনেনি | সে যুগে মোবাইল ফোনই ছিল
না 95% লোকের কাছে, ল্যাপটপ-ট্যাবলেট-কিন্ডল তো কল্পনাতীত
ব্যাপার | ফলে আমাদের কাছে ভিসিটিং ডে’র মুখ্য আকর্ষণ ছিল
মায়ের আদর, বাড়ির খাবার, গল্পগুজব আর গল্পের বই | এখন কিন্তু চিত্রটা একেবারে আলাদা | শুনেছি এখন নাকি বাচ্চাদের ভিসিটিং ডে’র ওই তিন ঘন্টার বেশিরভাগটাই
এখন কাটে মা-বাবার মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ
ঘেঁটে |
(b) ভিসিটিং ডে ব্যতীত অন্য রোববার :
এবার আসি মাসের প্রথম, তৃতীয় (ও
পঞ্চম) রবিবারের কথায় | সেদিন লাঞ্চের পর দুপুর 3:15 অবধি থাকত ঘরে বসে পড়াশুনা
করবার সময় | তবে সেসময় কেউ স্বেচ্ছায় পড়াশুনা করেছে বলে শুনিনি | পেট ভরে খাওয়ার
পর জমিয়ে ঘন্টা দু’য়েকের ঘুম দেবার এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায় ! মিশনের
হোস্টেলে সারাদিনে ওই একটা জিনিসই তো আমরা বুভুক্ষুর মতো খুঁজতাম – একটু ঘুমোনোর
সুযোগ | তবে আমাদের সময়ে একটা হোস্টেলে (অখন্ডানন্দ ভবন) সুপারিটেন্ডেন্ট পদে কোনো সন্ন্যাসী ছিলেন না, সেখানে ছিলেন একজন স্বৈরাচারী শাসক (বাংলার সুনীতিদা) এবং তাঁর এক মহা নচ্ছার শাগরেদ (শশাঙ্ক শেখর সরকার ওরফে ‘কাক’) - তাঁরা বাচ্চাদের ঐসময়ে ঘুমাতে দিতেন না | ওই হোস্টেলে
সবাইকে বই খুলেই বসতে হত, সঙ্গে চলত স্যারেদের রাউন্ড, চোখের পাতা বুজলেই খেতে হত
মার, নিদেনপক্ষে কানমলা না হয় বকুনি |
এই রোববার গুলোতে আমরা মাঠে যেতে
পারতাম সাড়ে তিনটের সময়ে, সপ্তাহের বাকি দিনের হিসাবে চল্লিশ মিনিট আগে | খেলা চলত
5:15 অবধি |
(8) বিকাল সাড়ে পাঁচটার পরবর্তী জীবনযাত্রা
:
আমাদের আবাসিক জীবনের রোববারগুলোর
বৈচিত্র্য (সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর সাপেক্ষে) সীমাবদ্ধ ছিল ওই বিকাল সাড়ে পাঁচটা
পর্যন্তই | এরপরের জীবনযাত্রা ছিল সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর সঙ্গে হুবহু এক | সেই বিকালের
টিফিনের পর প্রার্থনা কক্ষে যাওয়া, সেখান থেকে স্টাডিতে গিয়ে কোনো স্যারের
তত্বাবধানে চুপচাপ বসে নিঃশব্দে পড়াশুনা করা, তারপর রাতের খাওয়া এবং সেখান থেকে
ঘরে ফিরে রাত সাড়ে দশটায় লাইট না নেভা পর্যন্ত ‘সেল্ফ স্টাডি’ করা |
এই সেল্ফ স্টাডি’তে
পরীক্ষার আগের দিন ছাড়া অন্য কোনদিন পড়েছি বলে মনে পড়ছে না | তবে স্কুলের হোমওয়ার্ক করতাম ওই সময়ে | মূলতঃ এই
সময়ে হত চুটিয়ে আড্ডা ! (শুধু রবিবারের কথা বলছি না, আমি এখানে পুরো সপ্তাহের কথাই
বলছি | ) কখনো রুমের মধ্যেই শুরু হয়ে যেত আমাদের বিখ্যাত ‘চপ্পল ক্রিকেট’, যেখানে
কাগজের দলাকে রবার ব্যান্ড দিয়ে পেঁচিয়ে বানানো হত বল আর হাতের মধ্যে চটি ঘলিয়ে
সেটাকে ব্যাট হিসাবে ব্যবহার করা হত | মাঝেমাঝে বানানো হত আমমাখা, মুড়ি-চানাচুর, বাতাবি-লেবু
মাখা | বিকাল বেলাতেই গাছ থেকে আম, বাতাবি লেবু পেড়ে রাখা হত | মুড়িটা আমরা আনতাম
ডাইনিং হল থেকে চুরি করে, মানে বিকালের টিফিনে বেশির ভাগ দিনই মুড়ি দেওয়া হত, আমরা
খাওয়ার ফাঁকে খানিকটা মুড়ি জামা, পাঞ্জাবির পকেটে কিম্বা গ্লাসে ভরে ফেলতাম, এবং
খাওয়ার পর সাবধানে স্যার-মহারাজদের চোখ এড়িয়ে সেটা ঘরে নিয়ে আসতাম এবং একটা ডাব্বায়
সেটা জমা করতাম | বেশ খানিকটা মুড়ি জমলে একদিন সেটা মাখা হত |
সেল্ফ স্টাডিতে ভবনের স্যার ও
মহারাজরা একবার রাউন্ড দিতে আসতেন, ফলে একজনকে পাহারায় রেখে এসব নিষিদ্ধ কর্ম
সংঘঠিত করা হত | অবশ্য মাঝেমাঝে ধরা পড়ে গিয়ে বকা-মার-শাস্তি যে জোটেনি তাও নয় |
অতঃপর সাড়ে দশটায় হোস্টেলের
লাইটের মেইন স্যুইচ বন্ধ করে দেওয়া হত | এরপর শুয়ে পড়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি ছিল
না | পরের দিনই যে সাত সকালে উঠতে হবে আর শুরু হয়ে যাবে আমাদের কর্মব্যস্তময় আবাসিক
জীবন !
পুনশ্চঃ -
পাঠকদের জন্য মিশনের দৈনন্দিন
জীবনের সাম্প্রতিকতম দিনলিপি (শীতকালীন) দেওয়া হলো, ওখানে একবার চোখ বুলালেই সপ্তাহের বাকি
দিনের সঙ্গে রোববারের পার্থক্য আপনি বুঝতে পারবেন –
Daily Routine for junior
section
|
||
Week Days
|
Sundays/ Holidays
|
|
Rising Bell
|
5:30 a.m.
|
5:45 a.m.
|
Hot Drink
|
5:45 a.m.
|
6:00 a.m.
|
P.T.
|
6:00 a.m.
|
X
|
Cleanliness
|
6:25 a.m.
|
6:15 a.m.
|
Prayer: 1st
bell
|
6:35 a.m.
|
6:25 a.m.
|
Prayer: 2nd
bell
|
6:40 a.m.
|
6:30 a.m.
|
Study
|
7:05 a.m.
|
7:00 a.m.
|
Study Off
|
8:20 a.m.
|
8:20 a.m.
|
Breakfast
|
8:25 a.m.
|
8:25 a.m.
|
Grand Safai
|
X
|
10:30 a.m.
|
Bath
|
8:45 a.m.
|
11:00 a.m.
|
School Bell (1st
half)
|
9:25 a.m.
|
X
|
Assembly
|
9:35 a.m.
|
X
|
Lunch
|
12:35 p.m.
|
12:00 noon (visiting
days) / 12:15 pm
|
School Bell (2nd
half)
|
1:15 p.m.
|
X
|
School (2nd
half)
|
1:30 p.m.
|
X
|
Study
|
X
|
1:15 pm to 3:15 pm
|
Light Tiffin
|
4:05 p.m.
|
3:20 pm
|
Games
|
4:10 p.m.
|
3:30 pm (except
visiting days)
|
Washing
|
5:20 p.m.
|
5:20 p.m.
|
Tiffin
|
5:35 p.m.
|
5:35 p.m.
|
Prayer: 1st
bell
|
6:00 p.m.
|
6:00 p.m.
|
Prayer: 2nd
bell
|
6:05 p.m.
|
6:05 p.m.
|
Study
|
6:35 p.m.
|
6:35 p.m.
|
Study off
|
8:35 p.m.
|
8:35 p.m.
|
Dinner
|
8:40 p.m.
|
8:40 p.m.
|
Self-study
|
9:20 p.m.
|
9:20 p.m.
|
Light off
|
10:00 p.m.
|
10:00 p.m.
|
(Special prayer on
Sunday Morning. No P.T. on Sundays / Holidays)
|
- © অর্ঘ্য
দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, 29-01-2017
খুব ভালো লাগলো। পুরনো স্মৃতি ভেসে আসে এখনও মনের মধ্যে।
ReplyDeleteMany thanks for reading .... :)
DeleteKhub bhalo
DeleteRahara te chilam motamuti ek e routine .. purono din mone pore gelo.. ank sundar presentation
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ ...daily scheduleটা বোধহয় সব রামকৃষ্ণ মিশনেই কমবেশি একইরকম :)
DeleteAmader somoi shonibar sondhya, ar robibar sokal e kono study hall chhilo na, room study chhilo. Ar amra tate bose bikele je lamba cricket match hobe tar planning kortam.
ReplyDeleteআমাদের শনিবার রাতে Room Studyই ছিল, কিন্তু রবিবার সকালে study (hall)তে যেতে হত..তবে যদ্দুর মনে পড়ছে কোনো কোনো রবিবারে বোধহয় ছাড় মিলত ...... শনিবার রাতের room studyতে আমরা মাংস রান্নার গন্ধে উতলা হয়ে উঠতাম, কখন dinner bell পড়বে সেজন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম .......
Deletedarun laglo.. satyi tokhon samoy tai valo chilo..technology ese gie sei akritrim anondo ta kere nieche ajker generation er theke .. ekhon jogajog khub beshi sahoj hoye gieche bolei hayto samporker mulyo kome gieche :)
ReplyDeleteএখন সব কিছুকেই গ্রাস করেছে টেকনোলজি | গল্পগুজব, খেলাধুলো, গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়া - আধুনিক প্রজন্মের কাছে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই আজ | সবাই ঘাড় গুঁজে স্মার্টফোন টিপে চলেছে, সর্বক্ষণ |
Deletetobe jaddur mone hoy oi safai avijan ta sabaike korte hoto na ..ota pala kore hoto 5-6 jon er grp banie banie.. block leader er ekta gurutwopurno vumika chilo list banano te.. sabai tel marto tai prayer hall er committee tay dhukte jate ful tola..ful sajano.. mattress pata eguloi thakto.. ar nidenpokhe dining hall er khabar poribeshon..ar rising bell ta eto voyanok chilo je ghumkator ero ghum vangar pokhe jathesto chilo.. even ghumkature der kan er kache nie gie ghonta ta bajano hoto aneksamoy.. amader kaner porda vison shakto chilo bolte hobe.. keu i half kala hoye jai ni oi tibro ghonta dhoni sunbar poreo :P
ReplyDeleteমাসিক duty list তো ভবনের মহারাজ আর স্যারেরা মিলে ঠিক করতেন, সেখানে কোনো ছাত্রের ভূমিকা ছিল না | ফলে ভালো ডিউটি পাওয়ার জন্য মহারাজ আর স্যারেদের নেকনজরে থাকার দরকার ছিল, বিশেষ করে VS (বিদ্যার্থী সংসদ, সোজা কোথায় 'the boss') পদের ক্ষেত্রে | ওটার পরে 2nd best ডিউটি ছিল - prayer hall worker (মাসের পনেরো দিন এদের সকালের PT যেতে হত না)... আর সবথেকে খারাপ duty ছিল ওই time keeper :) :)
Delete