Skip to main content

দেশপ্রেমিক পাঁচুগোপাল



আজ বলিব পাঁচুগোপালের কাহিনী | পাঁচুগোপাল আমার প্রতিবেশী, চরম দেশপ্রেমিক | ল্যাপটপে নীলছবি দেখিবার পূর্বেও সে জাতীয় সঙ্গীত চালাইয়া প্যারেডের 'সাবধান' পজিশনে দাঁড়াইয়া থাকে | প্রত্যহ প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গের পরক্ষণে "ভারত মাতা কী জয়" শ্লোগান দিয়া থাকে | প্রতিটি আলোচ্য বিষয়ে ভারতীয় সেনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা তাহার অভ্যাস | ভারতীয় সেনা সীমান্তে চব্বিশ ঘন্টা দাঁড়াইয়া প্রহরা দেন, ফলে ব্যাঙ্ক-এটিএম-পোস্টাপিসে টাকা তুলিবার লাইনে সে প্রত্যহ পাঁচ ঘন্টা অনায়াসে দাঁড়াইয়া থাকে | কখনো রেগিস্তানের সীমানায় দ্বিপ্রহরে প্রহরারত সেনার কষ্টের কথা ভাবিয়া সে জলন্ত স্টোভের উপর দশ মিনিট বসিয়া থাকে, কখনো বা হিমালয়ের গিরিশ্রেনিতে প্রহরারত সেনার কষ্টের কথা ভাবিয়া মধ্যরাত্রে ফ্রিজ খুলিয়া তাহার ভিতর ঢুকিয়া ঘন্টা দুয়েক বসিয়া থাকে |


পাঁচুগোপালের এই দেশপ্রেমের হাতেখড়ি শৈশবে 'বর্ডার', 'গদর' প্রভৃতি হিন্দি সিনেমা দেখিয়া | কৈশোরে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ দেখিয়া দেশপ্রেম তাহার অধিকতর পোক্ত হয় | অতঃপর যৌবনে ইন্দো-পাক সীমান্তে দুই দেশের সেনার খন্ডযুদ্ধে নিজদেশের সাফল্যের উত্তেজনা তাহাকে আপাদমস্তক দেশপ্রেমী করিয়া তুলিয়াছে |


পাঁচুগোপালের নিকট দেশপ্রেমের অর্থ -
(১) ফেসবুক পোস্টে ভারতীয় সেনাদের স্যালুট জ্ঞাপন,
(২) স্বাধীনতা এবং প্রজাতন্ত্র দিবসে বিভিন্ন দেশভক্তিমূলক কর্মসূচি পালন, উদাহরণ - বাড়ির ছাদে পতাকা উত্তোলন, মিউজিক প্লেয়ারে "ইয়ে মেরে প্যারে বতন" শ্রবণ, টিভিতে দেশাত্ববোধক সিনেমা দর্শন ইত্যাদি
(৩) ক্রিকেট ম্যাচে টিম ইন্ডিয়ার সমর্থনে নীল জার্সি পরিধান করিয়া টিভির সম্মুখে হনুমানের ন্যায় লম্ফঝম্প করা
(৪) সীমান্তে পাকিস্তানের উপর সার্জিকাল স্ট্রাইকের নির্দেশদাতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার যাবতীয় সিদ্ধান্তকে অন্ধ সমর্থন
(৫) সোশ্যাল মিডিয়া এবং পাড়ার চায়ের দোকানে 'দেশদ্রোহী'দের খুঁজিয়া বার করিয়া গালমন্দকরণ এবং
(৬) সে যে নিজে চরম দেশপ্রেমিক তাহা সম্বন্ধে সকলকে জ্ঞাত করা !


রক্ত গরম করিবার দেশপ্রেমে পাঁচুগোপাল সদাসর্বদা প্রস্তুত, কিন্তু 'দায়িত্বশীল নাগরিকত্ব' পালনে তাহার বিন্দুমাত্র রুচি নাই | 'পাবলিক প্রপার্টি' রক্ষায় সে আদৌ যত্নশীল নয় | তাহার মতে এই কার্যের সহিত দেশপ্রেমের কোনো সম্বন্ধ নাই | অদ্যাবধি সে নির্দ্বিধায় প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে পানের পিক ফেলিয়াছে, নাক খুঁটিয়া ট্রেনের জানালায় ঘসিয়াছে, সুলভ শৌচালয়ে মূত্রত্যাগ করিয়া কখনো জল দেয় নাই, রাস্তাঘাটে কখনো ডাস্টবিন ব্যবহার করে নাই | 'গ্রাহক সচেতনতা' সম্বন্ধেও পাঁচুগোপাল রীতিমতো উদাসীন | দোকানে, ডাক্তারখানায় সে কখনই রসিদ চাহে না |


ধনী ব্যাক্তির 'কালোধন' পাঁচুগোপালের বিশেষ অপছন্দের বস্তু | উক্ত বস্তুটিকে পাঁচুগোপাল দেশের চরম দুর্দশার অন্যতম কারণ বলিয়া মনে করিয়া থাকে | অপরপক্ষে নিজের ব্যবসা বা স্ত্রীর টিউশন হইতে উপার্জিত অর্থের এক পয়সা সে কখনো ট্যাক্স হিসাবে সরকারকে দেয় নাই | বাড়ির একতলার ভাড়াটিয়াকেও সে কখনো মাসভাড়ার রসিদ দেয় নাই | বাকিরা যখন দিতেছে না, তখন সে দিবে কোন দুঃখে ? দেশরক্ষার দায় কি কেবল তাহার ?


© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, 09-12-2016


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...