Skip to main content

|| বালিশের পাশে, মনের সাথে ||


ছোটবেলায় একটা অভ্যাস ছিল আমার - পছন্দের জিনিসকে বিছানায় বালিশের পাশে নিয়ে রাতে শোওয়া | সারাদিন বগলদাবা করে রেখেও যেন সাধ মিটত না, ঘুমের মধ্যেও তাকে সঙ্গে চাই | তাছাড়া আমি ঘুমোচ্ছি, এই সুযোগে যদি চোর-ডাকাত এসে জিনিসটা নিয়ে নেয় ! পাশে নিয়ে শুলে জিনিসটা বেদখল হবার সম্ভাবনা কম থাকে |

স্কুলে পড়াকালীন নানা সময়ে নানা রকমের 'হবি' (শখ) ছিল আমার | যেমন – একেবারে প্রথমে, যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম, তখন অভ্যাস ছিল ট্রেনের টিকিট জমানোর | তারপর হল বাবল গামের সাথে পাওয়া ফুটবলারদের ছবিসহ কার্ড জমানোর | এরপর হল ‘স্টোন-স্টিকার’ জমানোর শখ - মনে আছে একটা ছোট্ট খাতায় সেগুলো আটকে রাখতাম | পরে এল ডাকটিকিট সংগ্রহের অভ্যাস | সবশেষে কয়েন কালেকশন | সব কটা হবি চলাকালীন সেই ‘হবি’-সংক্রান্ত ডাব্বা বা ডায়েরিটা প্রতি রাতে আমার সাথে বিছানায় শুতে যেত |

ছোট থেকেই কেন জানি আমার যুদ্ধবিগ্রহের প্রতি খুব শখ !! একটা খেলনা ‘স্টেইন-গান’ ছিল আমার, সেটা ছিল আমার প্রাণ | ফি বছর দুর্গাপুজোয় হাতে পেতাম নতুন 'ক্যাপ' ফাটানোর পিস্তল | তাছাড়া পিচবোর্ড কেটে তরোয়াল, বন্দুক ইত্যাদি কত যে বানিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই | এই সব যুদ্ধের সরঞ্জামেরও রাতে স্থান হত বিছানায়, আমার বালিশের ঠিক পাশে | একবার মনে আছে কালিপুজোর আগে অনেক বাজি কেনা হয়েছে, আনন্দে আমি আটখানা, এখন মুস্কিল হয়েছে যে বারুদ পাশে নিয়ে মা-বাবা কিছুতেই শুতে দেবে না | শেষমেষ রফা হল - আমি শুলাম মশারির মধ্যে আর বিছানার ঠিক পাশে, মশারীর বাইরে, আমার মাথা থেকে হাত দুই দূরে একটা চেয়ারের উপর সমস্ত বাজি সাজিয়ে রাখা হল |

ক্লাস ফাইভে উঠে নরেন্দ্রপুর মিশনে ভর্তি হওয়ার পর হোস্টেলে চলে গেলাম | ওখানে এসব আদিখ্যেতার জায়গা নেই | তাছাড়া ‘হবি’ বজায় রাখাও অসম্ভব – জিনিসপত্রের জোগান পাওয়া সম্ভব নয় সেখানে | তাই স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত শখের বাতিকে ভালোরকম ছেদ পড়ল | তবু বছরে তিনটে ছুটিতে বাড়ি আসতাম, তখন আবার ওই অভ্যাসগুলো নাড়াচাড়া দিয়ে উঠতো |

মিশনের পরিবেশে আমার আরেকটা অভ্যাস গড়ে ওঠে – গল্পের বই পড়ার | ধীরে ধীরে বাকি শখগুলো কেটে গিয়ে ওই একটা নেশাই বড় হয়ে ওঠে | তখন গল্পের বইটাই মাথার পাশে নিয়ে ঘুমাতাম - বছরের নয় মাস হোস্টেলে, তিন মাস বাড়িতে |

আমাদের ছোটবেলা যান্ত্রিক ছিল না, ফলে এই ছোট ছোট জিনিসগুলোই জায়গা করে নিয়েছিল আমার বালিশের পাশে | তাই এত সব স্মৃতি – ভালোলাগার, ভালোবাসার | এই যুগে জন্মালে মোবাইল, কিন্ডল, ট্যাবলেটের গন্ডি পেরিয়ে এইসব ছোট্ট, সহজ, সরল আনন্দগুলোকে পাশে পেতাম না | এই দিক থেকে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি |


© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, 17-12-2016


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...