Skip to main content

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১১ - জোড়া ভৌগলিক




আমাদের স্কুলে ভূগোল বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে দু’জন ছিলেন একই নামের | একজনের নামের আদ্যক্ষর পি.পি. (P.P.), আরেকজনের পি.এম. (P.M.) | প্রথমজন পড়াতেন বাংলা মাধ্যমের ছেলেদের, দ্বিতীয়জন ইংরাজি মাধ্যমের ছেলেদের |

প্রথমজন হাসানোর একটুও চেষ্টা করতেন না, বরং যথাসাধ্য গাম্ভীর্য বজায় রাখতেন, কিন্তু তাঁর কথাই আমাদের কাছে ছিল কৌতুকসম | দ্বিতীয়জন হাসাবার জন্য অনেক হাস্যকৌতুক বলতেন, সেগুলো বলে নিজেই হেসে কুটিকুটি হয়ে যেতেন, কিন্তু কোনটাতেই ছাত্রদের একটুও হাসি পেত না |
************************************************************
প্রথম ভাগ : পি.পি.
পিপিবাবু ছোটদের বলতেন, “তোমরা ছোট তাই তোমাদের কিছু বলছি না | বড় দাদাদের জিজ্ঞাসা করে দেখো | দুষ্টুমি করলে আমি মার দিয়ে ওদের চামড়া গুটিয়ে দিই |আর বড়দের বলতেন, “তোমরা এখন বড় হয়ে গেছ, মারধোর করলে খারাপ দেখায়, তাই কিছু বলছি না | নাহলে মেরে চামড়া গুটিয়ে দিতাম | জুনিয়র ভাইদের জিজ্ঞাসা করে দেখো ওদের আমি কিরকম শায়েস্তা করি |তাঁর এই অত্যধিক ‘চামড়া গুটানোর’ প্রবণতার জন্য আমরা তাঁর নাম দিয়েছিলাম ‘স্কিন রোলার’ !

একদিন তিনি নদী পড়াচ্ছেন, আমি এক মিনিটের জন্য একটু ঘুমিয়ে পড়েছি, বিশাখ নামের একটি ছেলে স্যারের কোনো কথা শুনে ফিক করে একটু হেসে ফেলেছে, অমনি উচ্চস্বরে, প্রবল বেগে, দাড়ি-কমা ছাড়া স্যার বলে উঠলেন, “তিন নম্বরের প্রশ্ন আসে গঙ্গার উচ্চগতি বর্ণনা কর..এক নম্বরের প্রশ্ন আসে গঙ্গার উৎপত্তি কোথায় লেখ..অর্ঘ্য ঘুমায়..বিশাখের বাড়ি অনেক দূর |এক দমেই স্যার পুরোটা শেষ করে ফেললেন | কথার তোড়ে আমার ঘুমের দফারফা !!

মাঝেমাঝেই এই জাতীয় কান্ড তিনি করে থাকতেন | একদিন কোনো ছেলে একটু দুষ্টুমি করছে, স্যার ওই ভূগোল সংক্রান্ত কোনো এক লাইনের সাথেই এক নিঃশ্বাসে যোগ করলেন, “তোমরা জানো গাছের রস হয়..আসলে কিন্তু মানুষেরও রস হয় |আমরা হাসব না চুপ করে থাকব সেটা বুঝে ওঠার আগেই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন তিনি |
***********************************************************
দ্বিতীয় ভাগ : পি.এম.
পিয়েমবাবু স্কুলে আসতেন অদ্ভুত পোশাকে | সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা বেল্ট, সাদা জুতো, সাদা মোজা | কোনদিন এই ড্রেসকোডের ব্যতিক্রম ঘটেনি | মাথার চুল তাঁর ছিল বাহারি | তাঁর গাড়ির রংটিও ছিল সাদা | সব মিলিয়ে বেশ অনবদ্য একখানা প্যাকেজ ! ছাত্ররা তাঁর নাম দিয়েছিল ‘যাত্রাপার্টি’ | নামটা যে খুব ভুল ছিল একথা বুকে হাত রেখে কেউ বলতে পারবে না |

এই স্যার ‘জোক’ বলতে ভালোবাসতেন | এই সুযোগে মাঝেমাঝেই ছেলেপুলে আব্দার করত, “স্যার ! একটা ‘জোক’ বলুন না প্লিজ !” এইসব ক্ষেত্রে স্যার মোটেও ছেলেদের নিরাশ করতেন না | দুয়েকটা নমুনা আমার মনে আছে –

১) ক্লাস নাইনের একটি সেকশনে বলেছিলেন – “একটা খুব রোগা আর একটা খুব মোটা লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল | এমন সময় রোগা লোকটা মোটা লোকটাকে বলল, ‘এ মাঃ ! তুই কি মোটা রে !!’ | অমনি মোটা লোকটাও বলল, ‘এ মাঃ ! তুই কি রোগা রে !!’ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ.........” |

নিজে একচোট হাসার পর খেয়াল করলেন ক্লাসের কোনো ছাত্রই হাসেনি | অতঃপর খানিকটা ক্ষুন্ন হয়ে বললেন, “এই জন্যই তোদের ক্লাসে জোক বলতে ইচ্ছা করে না | তোরা একটুও হাসিস না !”

অতঃপর পুরো ক্লাস “হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ........” ! টানা দু’ মিনিট !!

২) আরেকবার ক্লাস টেনের এক সেকশনে বলেছিলেন, “একদিন রাস্তা দিয়ে একটা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরে যাচ্ছে | আরেকজন লোক পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী ? ছেলেটা বলল, ‘না, আমরা ভাই-বোন | হাঃ হাঃ হাঃ........” 

এইবার ছেলেরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল | জোক শেষ হতে না হতেই পুরো ক্লাস অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল | স্যার ভীষণ খুশি !
***********************************************************

© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, 21-12-2016


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...