আমাদের স্কুলে ভূগোল বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে দু’জন ছিলেন
একই নামের | একজনের নামের আদ্যক্ষর পি.পি. (P.P.), আরেকজনের পি.এম. (P.M.) | প্রথমজন
পড়াতেন বাংলা মাধ্যমের ছেলেদের, দ্বিতীয়জন ইংরাজি মাধ্যমের ছেলেদের |
প্রথমজন হাসানোর একটুও চেষ্টা করতেন না, বরং যথাসাধ্য গাম্ভীর্য
বজায় রাখতেন, কিন্তু তাঁর কথাই আমাদের কাছে ছিল কৌতুকসম | দ্বিতীয়জন হাসাবার জন্য অনেক হাস্যকৌতুক
বলতেন,
সেগুলো
বলে নিজেই হেসে কুটিকুটি হয়ে যেতেন, কিন্তু কোনটাতেই ছাত্রদের একটুও হাসি পেত না |
************************************************************
প্রথম ভাগ : পি.পি.
পিপিবাবু ছোটদের বলতেন, “তোমরা ছোট তাই তোমাদের কিছু বলছি না | বড় দাদাদের জিজ্ঞাসা করে
দেখো | দুষ্টুমি
করলে আমি মার দিয়ে ওদের চামড়া গুটিয়ে দিই |” আর বড়দের বলতেন, “তোমরা এখন বড় হয়ে গেছ, মারধোর করলে খারাপ দেখায়, তাই কিছু বলছি না | নাহলে মেরে চামড়া গুটিয়ে
দিতাম | জুনিয়র
ভাইদের জিজ্ঞাসা করে দেখো ওদের আমি কিরকম শায়েস্তা করি |” তাঁর এই অত্যধিক ‘চামড়া
গুটানোর’ প্রবণতার জন্য আমরা তাঁর নাম দিয়েছিলাম ‘স্কিন রোলার’ !
একদিন তিনি নদী পড়াচ্ছেন, আমি এক মিনিটের জন্য একটু ঘুমিয়ে পড়েছি, বিশাখ নামের একটি ছেলে
স্যারের কোনো কথা শুনে ফিক করে একটু হেসে ফেলেছে, অমনি উচ্চস্বরে, প্রবল বেগে, দাড়ি-কমা ছাড়া স্যার বলে
উঠলেন,
“তিন নম্বরের প্রশ্ন আসে গঙ্গার উচ্চগতি বর্ণনা কর..এক নম্বরের প্রশ্ন আসে
গঙ্গার উৎপত্তি কোথায় লেখ..অর্ঘ্য ঘুমায়..বিশাখের বাড়ি অনেক দূর |” এক দমেই স্যার পুরোটা শেষ
করে ফেললেন | কথার তোড়ে আমার ঘুমের দফারফা !!
মাঝেমাঝেই এই জাতীয় কান্ড তিনি করে থাকতেন | একদিন কোনো ছেলে একটু
দুষ্টুমি করছে, স্যার ওই ভূগোল সংক্রান্ত কোনো এক লাইনের সাথেই এক নিঃশ্বাসে যোগ করলেন, “তোমরা জানো গাছের রস
হয়..আসলে কিন্তু মানুষেরও রস হয় |” আমরা হাসব না চুপ করে থাকব সেটা বুঝে ওঠার
আগেই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন তিনি |
***********************************************************
দ্বিতীয় ভাগ : পি.এম.
পিয়েমবাবু স্কুলে আসতেন অদ্ভুত পোশাকে | সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা বেল্ট, সাদা জুতো, সাদা মোজা | কোনদিন এই ড্রেসকোডের
ব্যতিক্রম ঘটেনি | মাথার চুল তাঁর ছিল বাহারি | তাঁর গাড়ির রংটিও ছিল সাদা | সব
মিলিয়ে বেশ অনবদ্য একখানা প্যাকেজ ! ছাত্ররা তাঁর নাম দিয়েছিল ‘যাত্রাপার্টি’ | নামটা যে খুব ভুল ছিল একথা
বুকে হাত রেখে কেউ বলতে পারবে না |
এই স্যার ‘জোক’ বলতে ভালোবাসতেন | এই সুযোগে মাঝেমাঝেই
ছেলেপুলে আব্দার করত, “স্যার ! একটা ‘জোক’ বলুন না প্লিজ !” এইসব
ক্ষেত্রে স্যার মোটেও ছেলেদের নিরাশ করতেন না | দুয়েকটা নমুনা আমার মনে আছে –
১) ক্লাস নাইনের একটি সেকশনে বলেছিলেন – “একটা খুব রোগা আর
একটা খুব মোটা লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল | এমন সময় রোগা লোকটা মোটা লোকটাকে বলল, ‘এ মাঃ ! তুই কি মোটা রে
!!’ | অমনি
মোটা লোকটাও বলল, ‘এ মাঃ ! তুই কি রোগা রে !!’ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
হাঃ.........” |
নিজে একচোট হাসার পর খেয়াল করলেন ক্লাসের কোনো ছাত্রই
হাসেনি | অতঃপর
খানিকটা ক্ষুন্ন হয়ে বললেন, “এই জন্যই তোদের ক্লাসে জোক বলতে ইচ্ছা করে না | তোরা
একটুও হাসিস না !”
অতঃপর পুরো ক্লাস “হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ........” ! টানা
দু’ মিনিট !!
২) আরেকবার ক্লাস টেনের এক সেকশনে বলেছিলেন, “একদিন রাস্তা দিয়ে একটা
ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরে যাচ্ছে | আরেকজন লোক পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী ? ছেলেটা বলল, ‘না, আমরা ভাই-বোন | হাঃ হাঃ হাঃ........”
এইবার ছেলেরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল | জোক শেষ হতে না হতেই পুরো
ক্লাস অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল | স্যার ভীষণ খুশি !
***********************************************************
© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, 21-12-2016
Comments
Post a Comment