আজ বলিব ফুলকুমারীর কথা | ফুলকুমারী আমার প্রতিবেশী, বেশ কিছু দিন ধরিয়া গুরুতর
অসুস্থ | তাহার
মা-বাবা এই বিষয়ে অতিশয় চিন্তিত, পূজা-পাঠ করিয়া, জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হইয়াও
লাভ হয় নাই | এখন কথা চলিতেছে মনোবিদের নিকট পরামর্শ লইবার | অসুখটি বড় কঠিন, ইহার নামটিও শক্ত - 'নার্সিসিসম' | গ্রীক পুরাণে বর্ণিত
নার্সিসাস নামক যুবক নিজ রূপে এমন মগ্ন হইয়াছিল যে প্রাণ পর্যন্ত হারাইতে হইয়াছিল
তাহাকে | ফুলকুমারীও
নিজ রূপে মজিয়া নিজেরই প্রেমে পড়িয়াছে |
ফুলকুমারীকে 'সুন্দরী' বলা যাইতে পারে | সদ্য স্কুলের চৌকাঠ পার
করিয়া সে মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়াছে | ফুল ফুটিলে ভ্রমর আপনি জুটিয়া যায় | উপরন্তু এই কথাও সত্য যে
এই বঙ্গভূমি যতই দুর্ভাগা হউক না কেন সেইখানে বুভুক্ষু, হ্যাংলা ছোকরাদের কখনই
অভাব হয় নাই | ফলাফল এক গুচ্ছ প্রেমের প্রস্তাব, ফটোতে অগণিত ফেসবুক লাইক, হোয়াটসঅ্যাপে ফ্রাস্টু
বালকদিগের প্যানপ্যানানি বার্তা | এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া ফুলকুমারী বুঝিল যে
সে দেখিতে সুন্দর | পূর্বে সে নিজের রূপ সম্বন্ধে সচেতন ছিল না, কিন্তু বসন্তের বাতাস
এইবার তাহার মন ও হৃদয়যন্ত্রকে বিপুল ভাবে আন্দোলিত করিল |
রোগের নামটি শুনিয়াছেন, উহার কারণও বুঝিলেন, এইবার রোগের উপসর্গের কথা
বলিব | কলিযুগে
'স্মার্টফোন' নামক একটি যন্ত্রের উদ্ভবে
মনুষ্যসমাজে অপ্রতুল যন্ত্রণার সৃষ্টি হইয়াছে | মাস ছয়েক হইল ফুলকুমারীকে তাহার বাবা
স্মার্টফোন ক্রয় করিয়া দিয়াছেন | পূর্বে ফুলকুমারী বাড়ির কার্যে তাহার মা কে
সাহায্য করিত, অবসর সময়ে টিভি দেখিত, বাড়িতে লোক আসিলে তাহাদের সাথে কথা বলিত | স্মার্টফোনের দৌলতে আজ সেই
সব ইতিহাস | এখন ফুলকুমারী সর্বক্ষণ মোবাইলে ঘাড় গুঁজিয়া থাকে, মাঝেমধ্যে মেসেজ পড়িয়া
মৃদুহাস্য করিয়া নিজমনে বিড়বিড় করিয়া কী সব বলে, অতঃপর পুনরায় কি-বোর্ড টিপিতে লাগে | ফুলকুমারীর এইরূপ স্বভাব
পরিবর্তনকে তাহার মাতৃদেবী অধঃপতনের সূচক বলিয়া মনে করিয়া যাহার-পর-নাই ক্ষুব্ধ হন | মধ্যে
মধ্যেই তিনি হুঙ্কার দেন, মেয়ের পৃষ্ঠদেশে চপেটাঘাত করিতে গিয়াও শেষ
মুহূর্তে নিজেকে সংযত করিয়া নেন | ফুলকুমারী চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার মেয়ে নয়, সেও চিৎকার করিয়া আত্মপক্ষ
সমর্থনে দু'-এক কথা বলিয়া থাকে | এই কলহ এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হইয়া
দাঁড়াইয়াছে |
ফুলকুমারী সেলফি-অন্ত-প্রাণ | কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকিলে ঘরে
সাজগোজ করিবার সময়ে সে খান পঞ্চাশেক নিজস্বী তুলিয়া থাকে - অর্ধেক অবিন্যস্ত কেশে
(আজকাল 'কেয়ারলেস
বিউটি'
নামক
একটি কনসেপ্ট বাজারে বেশ জনপ্রিয় হইয়াছে), অর্ধেক কেশ বিন্যস্ত করিবার পর | বারংবার সে কেশ বিন্যস্ত
করে,
নিজস্বী
লয়,
পরক্ষনেই
খুলিয়া ফেলে, পুনরায় নিজস্বী লয় | ফলতঃ সাজগোজ করিবার পর্বটি তাহার ঘন্টা দুয়েক
দীর্ঘ হয় | অনুষ্ঠানবাটিতে গিয়াও সে সর্বক্ষণ নিজস্বী তুলিতেই ব্যস্ত থাকে | অতঃপর বাড়ি আসিবার পথে
রাস্তায় খান পঞ্চাশেক এবং বাড়ি ফিরিয়া মেক-আপ ধুইবার পূর্বে ঘন্টা খানিক ব্যয়
করিয়া অগণিত সেলফি তুলিয়া থাকে | হাত মুখ ধুইয়া খানিক বিশ্রামের পর শুরু হয়
ফটো ঝাড়াই-বাছাই পর্ব | সবশেষে দশটি ফটো নির্বাচিত করিয়া ফেসবুকে
পোস্ট করা হয়, চল্লিশ জনকে 'ট্যাগ' করিয়া ! ফটোর সহিত থাকে একটি করে 'ক্যাপশন' - অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলি সম্পূর্ণ
অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয় হইয়া থাকে |
ফুলকুমারীর একটি অদ্ভূত স্বভাব - ফেসবুকে নিজ হস্তে পোস্ট
করা নিজস্বী নিজেই 'লাইক' দিবার | একদিন তাহাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিতে সে
বলিল যে ইহা মোটেও আশ্চর্যকর বিষয় নয়, তাহার সকল বন্ধু এই কার্যটি সগৌরবে করিয়া
থাকে | বুঝিলাম
দিনকাল বদলাইতেছে | ফুলকুমারী নিজের ফটোতে 'লাইক'সংখ্যা বাড়াইবার জন্য নানা
কৌশল লইয়া থাকে | যেমন - ধরা যাক বছরখানেক পূর্বে পোস্ট করা
একটি ফটোতে আশানুরূপ লাইক পড়ে নাই | ইতোমধ্যে ফুলকুমারীর ফেসবুক বন্ধুর সংখ্যা
বহুগুণ বাড়িয়াছে | ফুলকুমারী এই পুরাতন ফটোটিতে গিয়া কোনো একটি
কমেন্টের উত্তরে এক লাইন মন্তব্য যোগ করিয়া দেয় | এইবার ফুলকুমারীর সকল বন্ধুর টাইমলাইনে এই
খবরটি দেখায়, সঙ্গে ফটোটিও আবির্ভূত হয় | অতঃপর নতুন বন্ধুরা দলে দলে উহাতে লাইক দিতে
থাকে,
ফুলকুমারীর
ঝুলিতে 'লাইক-সংখ্যা' এবং আত্মতুষ্টি ক্রমশঃ
বাড়িতে থাকে |
আপনি যদি কখনো ফুলকুমারীর বাড়ি যান, তাহলে তাহাকে শত ডাকিয়াও
সাড়া পাইবেন না | স্মার্টফোনের দৌলতে সে আপাত মূক এবং বধির হইয়া
গিয়াছে | কিন্তু
চিন্তা করিবেন না, বাড়ির স্যুইচবোর্ড গুলির সন্ধান করিতে থাকুন, কোনো একটির পার্শ্বে ফুলকুমারীকে
(ফোন চার্জ-রত অবস্থায়) ঠিক খুঁজিয়া পাইবেন |
© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, 13-12-2016
Comments
Post a Comment