Skip to main content

বাঙালী সর্বভুক জাতি !!


অবাঙ্গালীরা ঠিকই বলে যে আমরা বাঙ্গালীরা সব কিছুই খাই, কোনো কিছুই পান করি না  |  কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয় – সমস্ত প্রকার পদার্থই আমরা খেয়ে থাকি | এমনকি ‘পান’ নামক জিনিসটিও আমরা খেয়ে থাকি  |  এছাড়াও এই সব পদার্থ ছাড়াও যত সব অপদার্থ আছে সেগুলোও আমরা মহানন্দে (বা মহাদুঃখে) খেয়ে থাকি  |  এই খাদ্যতালিকা নিয়ে একটু আলোচনা করছি এখানে –

পাগলে কী না বলে / ছাগলে কী না খায়” এই কথাটা আমাদের সকলেরই শোনা  |  এখানে ‘ছাগলে’ শব্দটার বদলে অনায়াসে ‘বাঙালী’ শব্দটা বসিয়ে দেওয়া যায়  |  সুস্বাদু কচি পাঁঠা থেকে শুরু করে বিস্বাদ পনীর – সবই আমরা বিনা দ্বিধায় পেটে চালান করে থাকি | শুধু তাই নয় - ছোটবেলায় ইস্কুলে পড়াকালীন বাঁ হাতের নখ, বইয়ের পাতার অংশবিশেষ, প্লাস্টিকের স্কেলের কোনা, রাবার ব্যান্ড, পেন-পেন্সিলের পশ্চাৎদেশ, বিভিন্ন গাছের পাতা-ফুল এমনকি নাকের শিকনি পর্যন্ত খেয়ে থাকি আমরা !

তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ বাঙালী বাদে বিশ্বের সমস্ত লোক পান করে বলে শুনেছি, কিন্তু ওসব হাঙ্গামা আমাদের নেই | জল-থাম্বস আপ-হুইস্কি-বিয়ার-সরবত আর বিড়ি-সিগারেট-চুরুট ইত্যাদি সবই আমরা খেয়ে থাকি | ওসব পান করে পানকৌড়ি হবার ঝামেলা আমাদের পোষায় না !

এসব তো গেল নানা ধরনের পদার্থর ব্যাপার | এবার আসি নানা অপদার্থের ব্যাপারে –

(১) চাপ – চাপ প্রধানতঃ দু’ধরণের – চিকেন বা মাটন চাপ এবং মানসিক চাপ | ‘চাপ’ বলতে সাধারনতঃ  দু’নম্বর চাপের কথাই বোঝানো হয় | এটি বাঙালীদের খাদ্যতালিকার একটি প্রধান অঙ্গ | যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে (যেমন কাউকে প্রোপোজ করা, স্কুল-কলেজ-চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়া, স্টেজে পারফর্ম করা ইত্যাদি) আমরা চাপ খেয়ে থাকি | এছাড়াও কচি বয়সে ছেলেরা বিভিন্ন মেয়েদের উপর ‘চাপ’ খায় |

(২) ল্যাদ – ‘ল্যাদ খাওয়া’র আক্ষরিক অর্থ হল ‘একটু জিরিয়ে (/বিশ্রাম) নেওয়া’ | বাঙালী অলস জাতি, ফলে ল্যাদ খেতে আমাদের জুড়ি নেই | যেকোনো পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজের আগে ও পরে দু’দফায় (এবং কাজের মাঝখানে বহু দফায়) আমরা একটু একটু করে ল্যাদ খেয়ে থাকি | ডাল-মাছ-মাংস-ভাত ইত্যাদি খাবার খেতে গেলেও খানিকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন তথা শক্তিক্ষয়ের ব্যাপার থাকে, কিন্তু এই ‘ল্যাদ’ হল এমন একটা জিনিস যেটা খেতে বিন্দুমাত্র শক্তিক্ষয় করতে হয় না | তবুও একটানা অনেকক্ষণ ল্যাদ খেলে আমরা যেন একটু ক্লান্ত হয়ে যাই, তখন সেই ক্লান্তি কাটানোর জন্য আরেক দফা ল্যাদ খেতেই হয় |

(৩) সেন্টু – ‘সেন্টু খাওয়া’র আক্ষরিক অর্থ হল ‘অভিমান করা’ বা ‘মানসিকভাবে একটু দুর্বল হয়ে যাওয়া’ | সেন্টু হলো বাঙালির আরেকটি প্রিয় জিনিস | যেসব কাজ ঝগড়াঝাটি, মারামারি করেও হাসিল করা যায় না সেসব কাজ সম্পাদনের জন্য আমাদের কাছে একটিই রাস্তা পড়ে থাকে – সেটা হলো সামনের লোকটিকে একটু ‘সেন্টু খাওয়ানো’, পাতি ভাষায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করা | এছাড়া আমাদের মধ্যে কিছু লোক থাকে যারা ‘এক্সক্লুসিভলি সেন্টু পাবলিক’, যে কোনো ছোট কথাতেই ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করা যাদের স্বভাব | অবশ্য পেটে জল পড়লে সব বাঙালীই কম-বেশি সেন্টু (/সেন্টি) হয়ে পড়ে !

(৪) বার / বাড় – এটি একটি মারাত্মক অ-খাদ্য জিনিস | যে একবার বাড় খেয়েছে, তার সর্বনাশ অনিবার্য | নেশার ঘোরে বন্ধুদের থেকে বাড় খেয়ে ‘চাপ’ খাওয়া মেয়েকে রাতে ফোন করে ‘কেস’ খেয়েছে – এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে আমাদের কলেজলাইফে | ভালো বাংলায় ‘বাড় খাওয়া’র অনুবাদ করলে দাঁড়ায় – “অন্যের মিথ্যা স্তুতিবাক্য শুনে নিজেকে বিশাল কেউকেটা মনে করে হঠকারী কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা” !!

(৫) কেস – জীবনে সবচেয়ে বেশী যে জিনিসটা আমরা খেয়ে থাকি সেটা হলো এই ‘কেস’ | এই ‘কেস’ খাওয়াতে আমাদের পরম হিতকর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং পাশের বাড়ির কাকিমারা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে থাকেন | পরের ভালো আমরা মোটেও দেখতে পারি না এবং সেই জন্য অন্যকে ‘গুছিয়ে কেস খাওয়ানো’র জন্য আমরা সর্বদা মুখিয়ে থাকি | এই কেস যখন বিপুল পরিমানে খেয়ে বদহজমের যোগাড় হয় তখন সেটাকে ‘কেস জন্ডিস’ বলে |

(৬) মার বা ‘ক্যাল’ - মা-বাবা এবং স্কুলের টিচারদের কাছ থেকে ছোটবেলায় আমরা এক ধরনের খাবার খুব বেশি পরিমানে খেয়ে থাকি | এগুলো হলো – কানমলা, কিল, চড়, লাথি, লাঠির বাড়ি, ঘুঁষি ইত্যাদি | এগুলোকে ছোটবেলায় ‘মার খাওয়া’ বলে জানলেও পরে কলেজে উঠে শুনেছিলাম এগুলোর নাম হচ্ছে ‘ক্যাল খাওয়া’ |

(৭) গালি – কারোর চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে হলে তাকে যেটা খাওয়াতে হয় সেটা হলো ‘গালি’ | এই কাজে আমরা বিশেষ পারদর্শী | কলকাতার যে কোনো ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে গেলে বিপক্ষ দলের সমর্থকদের থেকে এই ‘গালি’ খেয়ে এমন পেট ভরে যায় যে বাড়ি এসে আর ভাত-রুটি খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না |

(৮) হিট – কথায় কথায় ‘হিট’ খেয়ে যেতে আমাদের জুড়ি নেই | অটোওয়ালা খুচরো চাইলে, ভিড় বাসে কেউ ভুল করে পা মাড়িয়ে দিলে, টিম ইন্ডিয়া কম রানে অল আউট হয়ে গেলে, লোডশেডিং হয়ে গেলে আমরা ‘হিট’ খেয়ে যাই এবং চিল্লামেল্লি জুড়ে দিই |

(৯) আদর – এটি দুই প্রকার | একটি শ্লীল, আরেকটি অশ্লীল | মা-বাবার দেওয়া আদর, যেটি খেয়ে মনুষ্যসন্তানেরা বাঁদরে পরিণত হয়ে থাকে, সেটি শ্লীল আদরের গোত্রে পড়ে এবং এটির আলোচনা সর্বসমক্ষে চলতে পারে | প্রেমিক/প্রেমিকা এবং বর/বউ – এদের দেওয়া আদর ‘অশ্লীল আদর’এর পর্যায়ভুক্ত এবং এটি যত খুশি খাওয়া যেতে পারে কিন্তু এর আলোচনা ভদ্র বাঙালি সমাজে নিষিদ্ধ | এছাড়াও আজকাল ফ্রি-ইন্টারনেটের যুগে ছোট আদর-সংক্রান্ত টেলিফিল্ম অত্যন্ত সহজলভ্য, এগুলো বয়ঃসন্ধির তরুণ-তরুণীদের বিশেষ মনোরঞ্জন করে থাকে |

(১০) হাবুডুবু – হাবুডুবু খাওয়া দু’রকমের হয় | একটি হল ‘জলে হাবুডুবু খাওয়া’ - সাঁতার না জানা কোনো মানুষ জলে পড়ে গেলে এটি খেয়ে থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি জীবননাশক হয়ে থাকে | আর দ্বিতীয়টি হল ‘প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া’ – এটির সঙ্গে সাঁতার জানার কোনো সম্পর্ক নেই | এটি সাধারনতঃ জীবননাশক না হলেও অর্থনাশক, সময়নাশক এবং মানসিক শান্তিনাশক হয়ে থাকে | এটির সাথে ‘দিল্লি কা লাড্ডু’র বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায় – এটি খেলেও পস্তাতে হয়, না খেলেও পস্তাতে হয় |

উফফ .. অনেকক্ষণ ধরে বকবক করে আপনার মাথা খাচ্ছি ! আর নয় !! বিদায় ...........

© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, ২২-০৯-২০১৬



Comments

  1. লেখাটা দারুন! অনেক কিছু জানতে পারলাম!❤️❤️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...