Skip to main content

|| হরিপ্রসন্ন এবং আমি ||


 

হরিপ্রসন্ন লোকটার সাথে আমার আলাপ আজ থেকে পাঁচ বছর আগে
| সেসময় আমি স্কুল মাস্টারের চাকরি নিয়ে গোয়ালিয়র যাব, তারই আগে একদিন ডালহৌসি স্কোয়ারে গিয়েছি, এমন সময় লোকটার সাথে আমার আলাপ হল | তারিখটা ছিল ৬ই জুন, ২০১১ | এরপর তো আমি চললাম গোয়ালিয়র, আমার সাথে হরিপ্রসন্নও গেল সেখানে | আমারই কোয়ার্টারে তারও থাকবার ব্যবস্থা হল | তবে তার জন্য আলাদা বিছানা ছিল না. আমার ঘরে একটা বড় কাঠের টেবিল ছিল, তার উপরেই লম্বা হতো সে | অমন নির্বিবাদী, মুখচোরা কিন্তু ভয়ংকর কর্মঠ লোক আমি আর জীবনে দেখিনি, দিনে দশ-বারো ঘন্টাও কাজ করেও তার কোনো ক্লান্তি থাকত না, তবে মাঝেমাঝে একটু জ্বরজ্বর ভাব হত, গায়ে হাত দিয়ে দেখতাম যে বেশ গরম হয়ে গেছে, তখন একটু বিশ্রাম দেওয়া হত তাকে | একটু বিশ্রামের পরেই চাঙ্গা বোধ করত সে |

গোয়ালীয়রে আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর ছিলাম – ২০১১ সলের জুলাই মাস থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত | শহর থেকে দূরে ৩০০ ফুট পাহাড়ের উপর হাজার বছরের পুরনো কেল্লার মধ্যে অবস্থিত ১১৫ বছরের পুরনো স্কুল | সপ্তাহান্তে গাড়ি ভাড়া করে একবার নীচের শহরে যাওয়া ছাড়া মূল শহরজীবন থেকে এক প্রকার নির্বাসিতই ছিলাম বলা চলে | সেসময় আমার পরিবারের কারোর পক্ষেও আমার সাথে পাকাপাকি ভাবে ওখানে বাস করা সম্ভব ছিল না | এই নিঃসঙ্গ অবস্থায় হরিপ্রসন্নই ছিল আমার একমাত্র সঙ্গী |

২০১২ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি আসার পর হরিপ্রসন্ন ভারী অসুস্থ হয়ে পড়ে | অনেক কষ্টে সুস্থ করা হল তাকে | নেহাৎ মেডিক্লেম করা ছিল, তাই খরচের ধাক্কাটা তেমন গায়ে লাগেনি | এরপর চার বছর দিব্যি ছিল সে | মাঝেমাঝে জ্বর, সর্দি, কাশি হয়নি যে তা নয়, কিন্তু নিজেদের টোটকাতেই সেই রোগগুলোর নিরাময় বা উপশম করা হয়েছে, একবারের জন্যও ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি |

আজ থেকে পাঁচ দিন আগে (০৩-০৬-২০১৬ তারিখে) বিকালবেলায় হরিপ্রসন্নের খুব শরীর খারাপ হয় | খানিক পরেই জ্ঞান হারায় সে | টানা একদিন অচৈতন্য হয়ে ছিল সে | আমাদের কোনো চেষ্টাতেই কোনো লাভ হয়নি | কলকাতার এক নার্সিং হোমে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে ভেন্টিলেশনে রাখার পরামর্শ দিলেন, কিন্তু জীবনের গ্যারান্টী দিতে পারেননি | তাই অনর্থক আর অতগুলো পয়সা খরচ করার ঝুঁকি নিতে পারলাম না |
নিঃশব্দে চলে গেল হরিপ্রসন্ন |

যাওয়ার আগে শরীরের কিছু অঙ্গ দান করে গেছে – ভবিষ্যতে আমার ব্যবহারের জন্য !

ওহো.... হরিপ্রসন্নের সাথে আপনার আলাপই তো করানো হয়নি | কি কান্ড দেখেছেন !!
আসুন, আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই -

হরিপ্রসন্ন, এই হলেন আমার পাঠক, এনার চিত্তবিনোদনেই আমার সৃষ্টির সার্থকতা |
পাঠক, ইনি হলেন হরিপ্রসন্ন, ইয়ে মানে প্রয়াত শ্রী হরিপ্রসন্ন, ওরফে HP (হরির H আর প্রসন্নর P) G-42 নোটবুক (ল্যাপটপ), গত পাঁচ বছর ধরে আমার অসংখ্য সুখ-দুঃখের সাথী, আমার হরিহর আত্মা |

বছর খানেক আগে শুরু হওয়া আমার এই লেখালেখির বাতিকের পিছনেও এই হরিপ্রসন্নের ভূমিকা অপরিসীম | চুপচপ বসে থাকলে কিম্বা ঘুমের মধ্যে, এমনকি খাতা-পেন হাতে নিয়ে বসলেও এক লাইন লেখার আইডিয়াও আমার মাথায় আসে না | একমাত্র কি-বোর্ড হাতে পেলেই লেখা বেরোতে থাকে আমার হাত থেকে, মাথায় খেলতে থাকে আইডিয়া | এই অভ্যাস (সু নাকি কু জানিনা ) হরিপ্রসন্নের সৌজন্যেই |

Rest in peace, my friend !

গোয়ালীয়রে থাকাকালীন আমার ঘরে টেবিলের উপর শ্রীযুক্ত হরিপ্রসন্ন 

_______________________________________________
অর্ঘ্য দাস via
 টুকটাক লেখালেখি - Tuktak Lekhalekhi, রায়গঞ্জ, ০৮-০৬-২০১৬


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...