জনমেজয় কহিলেন,
“হে মহর্ষে, ভারতীয় ক্রিকেট ফ্যান সম্বন্ধে আপনার সবিস্তার বর্ণনা শ্রবণ করিয়া আমার
কর্ণযুগল ধন্য হইয়াছে | এক্ষণে
আপনাকে আরেকটি অনুরোধ করিব | আপনি পূর্বে
বলিয়াছিলেন যে কলিযুগে স্মার্টফোন নামক একটি যন্ত্র এবং তৎসহ সেলফি নামক এক প্রকার
যন্ত্রণার উদ্ভব হইবে | এই দুইয়ের
সম্মিলিত প্রভাব মনুষ্যসমাজে কিরূপ হইবে তাহা শুনিতে বড় কৌতুহল জন্মিতেছে | আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন |”
বৈশম্পায়ন
কহিলেন, “হে রাজন, কলিযুগে স্মার্টফোন নামক একপ্রকার বিচিত্র যন্ত্রের আবিষ্কার
হইবে | ইহা নিজে
স্মার্ট হইলেও মনুষ্যজাতিকে ইহা আনস্মার্ট করিয়া তুলিবে | ইহার প্রভাবে মনুষ্যগণ নিজস্ব সমস্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তি
ভুলিয়া অসামাজিক জীবে পরিণত হইবে | ইহার
তিন সহচর থাকিবে, যথা – ‘ইন্টারনেট’, ‘গেম’ এবং ‘অ্যাপস’ | মানুষের মুখে অন্ন না জুটিলেও তাহাদের স্মার্টফোনে ‘নেট
প্যাক’ অবশ্যই জুটিবে, ময়দানে না নামিয়াও যুবসমাজ ‘মোবাইল গেমস’এর দৌলতে পাকা
খেলোয়াড় হইয়া উঠিবে এবং সকালে রৌদ্র উঠিবে কিনা কিম্বা রাত্রে আমাশয় হইবে কিনা
সমস্ত তথ্য জানাইবার জন্য এক-একটি আলাদা মোবাইল অ্যাপসের জন্ম হইবে |
হে নরবর, এই স্মার্টফোন জনসংযোগ বৃদ্ধির নিমিত্ত সৃষ্ট হইলেও ইহার প্রভাবে মনুষ্যগণ প্রকৃতপক্ষে জনসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে | ইহা ব্যবহারের ফলে মনুষ্যগনের সামনাসামনি বসিয়া কথোপকথনের রীতি সম্পূর্ণ বিলোপ পাইবে | পূর্বপরিচিত চারিজন মানুষ বহুদিন পর একত্র হইয়াছে – এইরূপ ক্ষেত্রেও প্রত্যেকের মনোযোগ কেবলমাত্র উহাদের নিজস্ব স্মার্টফোনের উপরেই বিন্যস্ত থাকিবে, মুখ তুলিয়া পার্শ্বস্থ ব্যক্তিটির সহিত বাক্যালাপের আগ্রহ কাহারও থাকিবে না | সর্বক্ষণ ঘাড় গুঁজিয়া ফোন ঘাটাঘাটি করিবার ফলে মানবচক্ষুর ‘পাওয়ার’ বাড়িবে, তদুপরি ‘স্পন্ডিলাইটিস’ গোছের ব্যাধির প্রকোপও মনুষ্যসমাজে বৃদ্ধি পাইবে |
হে মহারাজ,
যন্ত্রের নাম স্মার্টফোন হইলেও উহার সাহায্যে সচরাচর কেহ ‘ফোন’ করিবে না | উহা মূলতঃ ‘গেম’ খেলিবার কাজে কিম্বা ফেসবুকে ‘এঞ্জেল তোর্সা’,
‘ড্যাজলিং তানিয়া’, ‘কিউটি তিস্তা’, ‘প্রিন্স রাহুল’, ‘দুষ্টু পিন্টু’ প্রভৃতিদের
চিত্রে ‘লাইক’ দিবার কার্যে অথবা হাইক কিম্বা হোয়াটসঅ্যাপে অজানা বান্ধবদিগের সহিত
‘চ্যাট’ করিতে ব্যবহৃত হইবে | এক
কথায় সমস্ত অকাজ ইহার দ্বারা সম্পন্ন হইবে কিন্তু একটিও কাজের কাজ ইহার দ্বারা
সম্ভবপর হইবে না |
হে মানবশ্রেষ্ঠ,
শয়নে-জাগরণে এই স্মার্টফোনই হইবে কলিযুগে মানুষের একমাত্র সঙ্গী | প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাইবার সময়েও তাহারা
স্মার্টফোনকে সঙ্গে লইবে | রাস্তা
পার হইবার সময়ে তাহারা স্মার্টফোনের হেডফোন কানে গুঁজিয়া হয় উচ্চগ্রামে সঙ্গীত শুনিবে
নতুবা দিনের একমাত্র ‘কল’টি করিবে | মনুষ্যশিশুরা
হাতে স্মার্টফোন না পাইলে খাবার মুখে তুলিবে না এবং গৃহে কোনো অতিথির আগমন হইলেই “তোমার মোবাইলে কী কী গেম
আছে ?” জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহার ঝাঁট জ্বালাইবে |
হে রাজন,
স্মার্টফোনের আকার সভ্য মানবসমাজে ‘স্টেটাস সিম্বল’ হিসাবে গণ্য হইবে | সুতরাং বিবর্তনবাদ এবং পুঁজিবাদের নিয়ম মানিয়া মোবাইল
কোম্পানিগুলি কর্তৃক নির্মিত স্মার্টফোনের আকার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে | এক সময় মনুষ্যগনের হস্তের তালু এবং জামা-প্যান্টের পকেট
ইহা ধারণের পক্ষে অপর্যাপ্ত হইয়া পড়িবে | তাহারও
বেশ কিছুকাল পর মনুষ্যাকৃতির তুলনায় উহা আকারে বড় হইবে এবং ট্রেন-বাস-ট্রামের বদলে
স্মার্টফোনেই মনুষ্যগণ চাপা পড়িবে |”
![]() |
চিত্রঋণ –
ইন্টারনেট
|
“হে মহারাজ, নিজস্ব
প্রতিবিম্বকে নিজহস্তে স্মার্টফোন ক্যামেরায় বন্দী বানাইবার নাম সেলফি | শুনিতে নিতান্ত নিরীহ হইলেও এই প্রক্রিয়াটি আদৌ সহজ হইবে
না | কিন্তু এ জগতে
নারীজাতির অসাধ্য কার্য কিছুই নাই, সুতরাং তাহারা এই সেলফি তুলিবার কার্যে
বিশেষভাবে দক্ষ হইবে | ফোনসহ
হস্তু উচ্চে স্থাপন করিয়া, গ্রীবা হেলাইয়া, রাজহংসের ন্যায় অধরযুগল সম্মুখে
প্রসারিত করিয়া তাহারা সেলফি তুলিবে | বিবর্তনের ফলে
বাঁদর হইতে মনুষ্যজাতির উদ্ভব হইয়াছে, কলিযুগে এই সেলফি তুলিবার আতিশয্যে মনুষ্য
হইতে রাজহংসের বিপরীতমুখী বিবর্তন’ শুরু হইবে |
![]() |
চিত্রঋণ –
ইন্টারনেট
|
হে রাজন,
‘নার্সিসিসম’ নামক একটি মনোরোগ সেলফি নামক যন্ত্রণাটির কারণ হইবে | গ্রীক পুরানের নার্সিসাস নামক যুবক নিজরূপে এমন প্রেমমগ্ন
হইয়াছিল যে তাহা উহার মৃত্যুর কারণ হইয়াছিল | কলিযুগেও মানবজাতি নিজরূপে এমন বিভোর হইবে যে প্রতি
মুহুর্তে উহারা আপন চিত্র স্মার্টফোন
ক্যামেরায় ‘ক্লিক’ করিবার এক বিচিত্র ক্রীড়ায় মত্ত হইবে | এই কার্য সম্পাদন করিতে গিয়ে তাহারা বাহ্যিক পরিবেশ,
সমাজ-সংসার প্রভৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইবে | নিজ প্রতিবিম্ব স্মার্টফোনে দর্শন করিয়া ইহারা চরম
আত্মপ্রসাদ লাভ করিবে এবং বস্তাভর্তি ‘লাইক’ নামক লোভনীয় বস্তুটি পাইবার আশায় উহা
ফেসবুকে পোস্ট করিবে | কেহ কেহ আবার নিজ ফটো নিজেই লাইক করিবে, ঘটনাটি কিঞ্চিত আত্মলিঙ্গমপশ্চাৎপুরমের সহিত তুলনীয় হইবে | সুতরাং,
সংক্ষেপে বলিতে গেলে নিজ ঢাক নিজ হস্তে পিটাইবার অপর নামই হইল সেলফি !
হে নরশ্রেষ্ঠ ! কলিযুগে
দিকে দিকে ‘সেলফি ক্যুইন’ নামক এক প্রজাতির উদ্ভব হইবে | ইহাদের জীবনের বারো আনা কার্যকলাপ সেলফি-কেন্দ্রিক হইবে | ইহারা প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় সেলফি তুলিবে এবং সোশ্যাল
মিডিয়ায় তা পোস্ট করিতে থাকিবে | এই
কার্যে বিভিন্ন ফটো এডিটিং অ্যাপসগুলি
উহাদের বিশেষ সহায়তা করিবে, যাহার সহায়তায় পোড়ামুখকেও চাঁদবদনে পরিনত করা সম্ভবপর
হইবে | ‘সেলফি-স্টিক’
নামক একটি যন্ত্রের আবিষ্কার সেলফি তুলিবার কার্যটিকে পূর্বাপেক্ষা অনায়াস করিয়া
তুলিবে | অভাগা এই দেশে
বুভুক্ষু ছেলের দল অপেক্ষা করিয়া থাকিবে এই সব সেলফি-ক্যুইনদের নিত্যনতুন ফটোর
জন্য, ফেসবুকে উহা আসিবামাত্র উহারা তাহা ঝড়ের গতিতে লাইক করিবে এবং চরম আদিখ্যেতা
মার্কা কমেন্ট করিয়া নিজেদের হাস্যস্পদ করিয়া তুলিবে | সেলফি-ক্যুইনরা এই লাইক ও কমেন্ট দেখিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ
করিবে এবং পরবর্তী সেলফির জন্য প্ল্যান করিতে থাকিবে |”
জনমেজয় কহিলেন, “হে মুনিপুঙ্গব ! আপনি
অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন |”
© অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি , দুর্গানগর,
০৮-০৪-২০১৬
Comments
Post a Comment