______________________________________________________________________
ডমরুধর নেহাৎ
বোকা নয় কিন্তু মুস্কিল হল লোকটা বড্ড ইমপ্র্যাক্টিকাল
| কতবার তাকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি
যে সব ব্যাপার সিরিয়াসলি নিতে হয় না, কিন্তু কে কার কথা শোনে ! এই তো কয়েকদিন আগে
তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম যে বিভিন্ন অভিনেতা তাঁদের সিনেমায় যেসব তাত্ত্বিক
কথা বলেন, যেসব ইমোশানাল সিন করেন সেগুলি পুরোটাই ‘scripted’, সেগুলোর জন্য তাঁরা
ঝুড়ি ঝুড়ি পয়সা পান | আসল জীবনে তাঁরা যেসব কাজ করেন সেগুলোর সাথে এইসব
তাত্ত্বিক কথার কোনো সম্পর্কই নেই, কারণ real life আর reel life-এর মধ্যে কোনো
সম্বন্ধই নেই, তবু বেকুব ডমরুধরটা তা
বুঝতে চায় না !
এই তো কদিন আগে
নাসিরুদ্দিন শাহ কদিন আগে কোন আতঙ্কবাদীর ফাঁসির বিরুদ্ধে কি একটা বললেন আর গোয়াঁড়
ডমরুধরটা বেঁকে বসলো ! ও বলছিল সেই ‘A Wednesday’ সিনেমার কথাটা যেখানে
নাসিরুদ্দিন শাহ নিজের ঘর পরিষ্কারের যুক্তি দিয়ে চারজন জঙ্গিকে মেরে নিকেশ
করেছিলেন ! আমি কতবার বললাম যে ওটা ভদ্রলোকের সিনেমার মুখোশ আর এটা সত্যি চেহারা,
তবু ডমরুধর মানতে নারাজ !
শেষে বাধ্য হয়ে
‘Gangs of Wasseypur’ সিনেমাটা খুলে রামধারী সিংয়ের মুখে সেই উক্তিটা ডমরুধরকে
শোনালাম - “যতদিন ইন্ডিয়াতে সিনেমা নামক
বস্তুটা থাকবে, ততদিন লোকজন বেকুব বনতে থাকবে !”
ডমরুধর এই একই
রকম বেঁকে বসেছিল আমির খানের সেই সাক্ষাত্কার দেখার পর যেটাতে আমির খান এই
অসহিষ্ণু দেশে থাকতে তাঁর স্ত্রী কতটা ভীত সেটা বলেছিলেন | ডমরুধর বার বার সেই
স্বদেশপ্রেমমূলক ‘sarfarosh’ কিম্বা ‘সত্যমেব জয়তে’র উদাহরণ দিচ্ছিল যেখানে আমির
খানকে স্বদেশপ্রেমের জন্য চোখের জল ফেলতে দেখা গিয়েছে | হতভাগা ডমরুধরকে সেদিন আমি
বুঝিয়ে পারিনি যে কর্মক্ষেত্রে মানুষকে অনেক কিছু করতে হয় যেটা সে সাধারণ জীবনে
মোটেও সমর্থন করেনা কিম্বা পালন করেনা !
ডমরুধরকে সেদিন John
Lennon-এর বিখ্যাত ‘Imagine’ গানটা শোনালাম | সেই গান শুনে সে তো বড় আপ্লুত ! আমাকে বলল, “অর্ঘ্য, সেই দিনটা
কল্পনা কর যেদিন সত্যিই এরকম হবে | দেশের গন্ডি মুছে যাবে, থাকবে না কোনো কোনো জাতীয়তাবাদ বা
ধর্মের বেড়াজাল বা ভেদাভেদ; সম্পদের
থাকবেনা কোনো কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদে থাকবে সকলের সমান
অধিকার |”
দেখলাম ডমরুধরের চোখটা উত্তেজনায় চিকচিক করছে |
আমাকে বাধ্য হয়ে
বলতে হল যে গায়কেরা গান বাঁধেন কারণ সেটাই তাঁদের
পেশা | সেই
গানে তাঁরা এমন কিছু স্বপ্ন দেখান বা জীবনদর্শনের কথা বলেন যেগুলো আপাতসুন্দর
কিন্তু বাস্তবে অসম্ভব | ওই গানের রচয়িতা নিজেই কোনদিন ওগুলো মানেন নি, মানবেন না | বন্যেরা যেমন বনে সুন্দর, শিশুরা
যেমন মাতৃক্রোড়ে, তেমনিই এসমস্ত সুন্দর সুন্দর কথা গানের লাইনেই ভালো লাগে | যেমন লেনন গাইলেন “imagine no
possession”, অথচ সেই গান বেচে লক্ষ লক্ষ
ডলার কামালেন !!
বস্তুতঃ ইতিহাস
সাক্ষী, লেননের হত্যার পিছনে এই গানেরই পরোক্ষ ভূমিকা আছে | লেননের হত্যাকারী নিজের বয়ানে
বলেছিল যে সে প্রথম জীবনে লেননের অন্ধ ভক্ত ছিল, লেননকে সে তার জীবনের ধ্রুবতারা
বলে মানত, কিন্তু যেদিন সে খেয়াল করল যে লেনন নিজেই তাঁর গানে উল্লিখিত
আদর্শগুলোকে নিজের জীবনে মানছেন না সেদিন থেকেই তার মাথা বিগড়ে যায় ও সে লেননের
প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে ওঠে !
সপ্তাহখানেক আগে
ডমরুধর আমার কাছে এসেছিল | এবারের আলোচনা এক কবিকে কেন্দ্র করে যিনি প্রগতিশীল ও
উন্নতশির হিসাবে সুপরিচিত | তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত লাইন হল - “তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, তফাৎ শুধু
শিরদাঁড়ায়” | এই কবি প্রবল
প্রতাপান্বিত সরকার বাহাদুরের নানা কাজের বিরুদ্ধে অতীতে বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ
জানিয়েছেন, সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছেন |
এই কবি বর্তমানে কলকাতার যুবমানসে যথেষ্ট সমাদৃত | তাঁর
লেখা পঙক্তিমালা বর্তমান যুবসমাজ নানা ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে
তুলে নিয়েছে | এ হেন কবিই বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলের
নির্বাচনী প্রচারের জন্য গান লিখবেন বলে কলম তুলে নিয়েছেন !
ডমরুধরকে আমি বললাম যে কবি লিখেছিলেন “তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়” কারণ
কবিতা লেখাই তাঁর পেশা | সেই কবিতার সাথে তাঁর
নিজের শিরদাঁড়ার কোনো সম্পর্ক নেই | আজ তিনি আর্থিক বা অন্য
পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়েছেন নির্বাচনী গান লিখতে | এতে
অসুবিধার কি আছে ? তাছাড়া কবিতা, গল্প বা সিনেমা ইত্যাদি যে একটা ‘Art of fiction’
সেটা বুঝতে হবে | কবিতার মধ্যে উল্লিখিত চরিত্র আর আসল রক্ত-মাংসের
কবি – এই দু’জন আলাদা হতেই পারেন | বস্তুতঃ দুটো যে এক হতেই
হবে – পাঠকের এই দাবি কিন্তু অত্যন্ত অন্যায় |
ডমরুধরের এই
একটা বড় মুশকিল হল যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সে কাউকে কাউকে নিজের মনের দেবাসনে বসিয়ে
দেয় | সেই
মানুষটা নিজে দেবত্বের দাবী না করা সত্ত্বেও ! এরপর যখন রক্তমাংসের সেই মানুষটা
কোনো ভুলভ্রান্তি করে, পরিস্থিতির চাপে কোনো ক্ষেত্রে নীতির সাথে আপোস করতে বাধ্য
হয়, তখুনি ডমরুধরের মনের সেই সিংহাসন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় আর সেই দেবতা হন
ভূপতিত | তখুনি
তাঁর ঘাড় ধরে তাঁকে দু-চার ঘা না দিলে তখন আর ডমরুধরের চলে না !
_________________________________________
অর্ঘ্য দাস @
টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর, ২১-০৩-২০১৬
Realism at its best
ReplyDeleteথ্যাঙ্কু !! :)
ReplyDeleteআসলে আমরা যারা সাধারণ মানুষ সবাই ডোমরুধর। এই কল্পিত ডোমরুধরের মতো আমারও ইচ্ছে করে দু-চার ঘা দিয়ে দিতে। দারুন হয়েছে লেখাটা।
ReplyDelete