(কৈফিয়ৎ: আমাদের পাড়ার এক দাতব্য চিকিৎসা
প্রতিষ্ঠানের ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে একটা লেখা দিতে বলা হয়েছিল | গাইডলাইন হিসাবে
বলা হয়েছিল যে লেখাটি informative এবং তার বিষয় স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত হলে
ভালো হয় | স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের লেখায় মৌলিকত্ব থাকা সম্ভব নয়, কারণ সমস্ত তথ্য
ইন্টারনেট বা অন্যান্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে হয় | এছাড়া এরকম লেখার আরেকটা অসুবিধা
হল যেহেতু এর পাঠক সাধারণ মানুষ, ফলে এই লেখায় যতসম্ভব বিজ্ঞানের কচকচি দুরে সরিয়ে
খুব সহজ, প্রাঞ্জল ভাষায়, যাকে বলে layman’s language-এ মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো
ব্যাখ্যা করতে হয়, যা রীতিমত কঠিন কাজ | যাইহোক, শেষমেষ একটা লেখা খাড়া করেছি | লেখাটাকে যাতে হারিয়ে না ফেলি সেজন্য এই ব্লগে জুড়ে দিলাম | কোনরকম বৈজ্ঞানিক ত্রুটি যদি পাঠকের
নজরে আসে তাহলে জানাতে দ্বিধা করবেন না |)
_____________________________________________________________________________
ইংরাজি ভাষায় একটা প্রচলিত কথা আছে - Necessity is the mother of all
inventions – অর্থাৎ প্রয়োজনের তাগিদই আবিষ্কারের উৎস | কিন্তু আজ পর্যন্ত
মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে তার অনেকগুলোই হয়েছে আচমকা,
কোনরকম পূর্ব পরিকল্পনা বা প্রয়োজনের তাগিদ ছাড়াই | এরকম accidental invention / discovery -এর তালিকায় রয়েছে এক্স-রশ্মি,
পেনিসিলিন, রক্ততঞ্চন রোধকারী রাসায়নিক, পেসমেকার, লাফিং গ্যাস, স্যাকারিন, মাইক্রোওয়েভ
ওভেন, সুপার-গ্লু ইত্যাদি | এখানে সে রকমই কয়েকটি আকস্মিক আবিষ্কার সম্বন্ধে
আলোচনা করা হল -
(১) এক্স-রশ্মি - আজকালকার দিনে শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গের এক্স-রে করাননি
এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর | এই এক্স-রশ্মির আবিষ্কার কিন্তু হয়েছিল সম্পূর্ণ আকস্মিক
| ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম কনরাড রন্টজেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে ‘ক্যাথোড
রে টিউব’ নিয়ে কাজ করছিলেন | জিনিসটা খানিকটা আজকের দিনের ফ্লুরোসেন্ট লাইট
বাল্বের মত ব্যাপার | একটা সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরের ভেতর বসে তিনি স্বচ্ছ কাঁচ
নির্মিত একটা টিউবের ভেতরের সমস্ত বাতাস বের করে দিয়ে তারপর সেখানে একরকমের গ্যাস
ভরে তার মধ্যে দিয়ে উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ চালনা করেন | এর ফলে সমস্ত কাঁচের
টিউবটা থেকে একরকমের ফ্লুরোসেন্ট আলো নির্গত হতে থাকে | এরপর তিনি ওই টিউবটিকে
একটা মোটা কালো কাগজ দিয়ে ভালো করে মুড়ে দেন, ফলে আলোর বাইরে আসা বন্ধ হয় | আচমকা তিনি
খেয়াল করেন যে নয় ফুট দূরত্বে থাকা একটি পর্দা বা স্ক্রিন (বেরিয়াম
প্ল্যাটিনোসায়ানাইড নামক রাসায়নিকে নিষিক্ত) ওই ক্যাথোড রে টিউবের প্রভাবে আলোকিত
হয়ে উঠছে | কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয় ! খানিক ভাবনাচিন্তার পর বিজ্ঞানী
রন্টজেন এই সিদ্ধান্তে এলেন যে ক্যাথোড রে টিউব থেকে নিশ্চয়ই একরকম অদৃশ্য রশ্মি
নির্গত হচ্ছে যা ওই মোটা কালো কাগজকে ভেদ করে বেরিয়ে এসে ওই স্ক্রিনকে আলোকিত করছে
| রন্টজেন এই অজানা রশ্মির নাম দেন X-রশ্মি, ঠিক যেরকম অঙ্কের
ক্ষেত্রে আমরা অজানা রাশিকে ‘X’ অক্ষর দ্বারা সূচিত করি | পরে আবিষ্কর্তার নামে এই রশ্মির নাম হয়
রন্টজেন-রশ্মি | এই এক্স-রশ্মির সামনেই আমরা যখন দাঁড়াই, তখন এই রশ্মি আমাদের
চামড়া-মাংস ভেদ করে বেরিয়ে যায়, কিন্তু হাঁড় ভেদ করে যেতে পারে না | ফলে অন্যদিকে
রাখা এক্স-রে প্লেটে আমাদের হাঁড়ের নেগেটিভ ছবি ফুটে ওঠে |
(২) অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন - ধরা যাক আপনি একজন সরকারী চাকুরে | পুজোর
সময় কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে আপনি দার্জিলিং ঘুরতে গেলেন | এরপর ফিরে এসে প্রথম
দিন অফিসে গিয়ে আপনার প্রাপ্তি কি ? সেই একঘেঁয়ে কর্মব্যস্ততা, বিরক্তি, বড়জোর
নতুন রং হওয়া অফিসের দেওয়াল | কিন্তু ১৯২৮ সালে লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালের
ব্যাক্টেরিয়লজির অধ্যাপক ডঃ আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং তাঁর ছুটি কাটিয়ে কর্মক্ষেত্রে
ফিরে আচমকাই পেনিসিলিয়াম নামক ছত্রাকটির সন্ধান পান | ছুটিতে যাওয়ার আগে ফ্লেমিং
সাহেব কতগুলো পেট্রিডিসে (কাঁচের ছোট পাত্র) স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামের একধরনের
ব্যাকটেরিয়ার কালচার (চাষ) করেছিলেন | ছুটি থেকে ফিরে সেদিন ফ্লেমিং সাহেব ওই
পেট্রিডিসগুলো পরিষ্কার করছিলেন |
পেট্রিডিসগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই এই কদিনে ব্যাকটেরিয়াগুলো বংশবৃদ্ধি করে
কলোনি বানিয়ে ফেলেছে, খালি চোখেই এই কলোনিগুলো দেখা যায়, সাদা সাদা ছোপের মতো |
আচমকা ফ্লেমিং সাহেব খেয়াল করলেন যে একটা পেট্রিডিসে খানিকটা জায়গায় এক রকমের
ছত্রাক জন্মেছে আর সেই জায়গাটায় এই ব্যাকটেরিয়াগুলো বংশবৃদ্ধি করতে পারে নি |
ফ্লেমিং সাহেব বুঝলেন যে এই বিশেষ প্রজাতির ছত্রাকটির মধ্যে ব্যাকটেরিয়াকে
প্রতিরোধ করার শক্তি আছে | এই বিশেষ ধরনের ছত্রাকটিকেই বর্তমানকালে আমরা পেনিসিলিয়াম
নাম চিনি | ফ্লেমিং সাহেবের আকস্মিক আবিষ্কারের পর এটিকে নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার
পর তৈরী হয় বিশ্বের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন |
(৩) রক্ততঞ্চন রোধকারী রাসায়নিক - বঁটি বা ছুরি দিয়ে সব্জি কাটতে গিয়ে অনেক
সময়েই অসাবধানতাবশতঃ আমাদের আঙ্গুলের অল্প খানিকটা জায়গা কেটে যায় | ক্ষতস্থান
দিয়ে অল্প রক্ত বেরোনোর পর খানিক সময়ের মধ্যে রক্ত-নিঃসরণ আপনা থেকেই বন্ধও হয়ে
যায় | খেয়াল করলে দেখা যাবে যে ক্ষতস্থানের মুখে খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত
বেরোনোর জায়গাটা বন্ধ করে দিয়েছে | আবার যেটুকু রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে বাইরে পড়েছে
সেদিকে তাকালেও দেখা যাবে যে ওই রক্তটাও জমাট বেঁধে গিয়েছে | এই প্রক্রিয়াকে ‘রক্ত
তঞ্চন প্রক্রিয়া’ (blood coagulation / blood clotting) বলে | আমাদের রক্তে মোট
তেরোটি উপাদান থাকে যা রক্ত তঞ্চনে সহায়তা করে | এখন ধরা যাক আপনি রক্তদান শিবিরে
গিয়ে রক্ত দিলেন বা কোনো ব্লাড-টেস্ট
করাবার জন্য রক্ত দিলেন | এবার এই রক্ত যদি জমাট বেঁধে যায় তাহলে তো অসুবিধা, কারণ
সেই জমাট বাঁধা রক্ত কারোর দেহে প্রতিস্থাপন করা যাবে না বা অনেক ক্ষেত্রেই তা
দিয়ে রক্ত-পরীক্ষাও করা যাবে না | ফলে এসব ক্ষেত্রে রক্তের তরলতা বজায় রাখতে এবং
তঞ্চন প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখতে এক প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যাকে ‘তঞ্চন
প্রতিরোধকারী’ (anticoagulant) বলা হয় | নানাধরনের
রোগের চিকিৎসায়ও(deep vein thrombosis, pulmonary embolism, myocardial infarction , ischemic stroke) এই রাসায়নিকের ভূমিকা
গুরুত্বপূর্ণ | | ১৯৩০ সালে মার্কিন বায়োকেমিস্ট, বৈজ্ঞানিক কার্ল পল লিংক আকস্মিকভাবেই
ওয়ারফারিন (warfarin) নামক এক প্রকার anticoagulant-এর সন্ধান পান | উইসকন্সিন
প্রদেশের এক চাষী তাঁর দারস্থ হয় – ওই চাষীর গবাদি পশুরা এক অজানা কারণে
রক্তস্রাবে আক্রান্ত | বৈজ্ঞানিক কার্ল ওই পশুদেরকে দেওয়া খাবারের উপাদান বিশ্লেষণ
করতে গিয়ে এক ধরনের রক্ততঞ্চন-রোধকারী রাসায়নিকের সন্ধান পান যা তিনি ওই খাবারের
মিশ্রণ হতে নিষ্কাশন করতে সক্ষম হন | এই রাসায়নিককেই বর্তমানে আমরা warfarin নাম
চিনি যা আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয় |
(৪) প্রতিস্থাপনযোগ্য পেসমেকার (Implantable pacemaker): আমেরিকান নাগরিক উইলসন
গ্রেটব্যাচ পেশায় ছিলেন ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার | ১৯৫০ সালে তিনি হার্টবিট রেকর্ড
করার জন্য একটি মেশিন (অসিলেটর) বানানোর প্রয়াসে ছিলেন | মেশিনের ভেতর তিনি ভুল
করে একটি যন্ত্রাংশের জায়গায় অন্য একটি যন্ত্রাংশ যোগ করে দেন | পরে পুরো মেশিন
তৈরী হলে তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করেন যে মেশিনটি পর্যায়ক্রমিক ভাবে স্পন্দন তৈরী
করছে, ঠিক হৃদস্পন্দনের মত | উইলসন সাহেব পরবর্তী দুই বছর এই মেশিনটিকে উন্নততর
করার জন্য গবেষণা চালিয়ে যান এবং তিনি তৈরী করে ফেলেন বিশ্বের প্রথম (মানবশরীরে)
প্রতিস্থাপন যোগ্য পেসমেকার | এর পূর্ববর্তী পেসমেকার গুলো ছিল টিভির মত বিশাল
আয়তনযুক্ত |
(৫)লাফিং গ্যাস (নাইট্রাস অক্সাইড) : নাইট্রাস অক্সাইড হল একপ্রকার বর্ণহীন
গ্যাস যা প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভেতর ঢুকলে ঘাড়ে-মাথায় কেমন একটা সুড়সুড় করতে
থাকে – তাতে অনেকের হাসি পেতে থাকে | এই গ্যাস একটু বেশিমাত্রায় কাউকে শুঁকিয়ে
মিনিটখানেক বেশ আরামে বেহুঁস করে রাখা যায় | এই অবস্থায় তার উপর ছোটখাটো
অস্ত্র-চিকিৎসা চালালে সে কোনো যন্ত্রণা অনুভব করবে না | চিকিৎসাবিজ্ঞানে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ এই গ্যাসটি সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করে ফেলেন ইংরেজ বৈজ্ঞানিক
জোসেফ প্রিস্টলি, ১৭৭২ সালে, নাইট্রিক অ্যাসিডে লোহাচূর্ণ যোগ করে |
এইরকমই নানা মজাদার কাহিনী জুড়ে আছে বিশ্বের অসংখ্য উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক
আবিষ্কারের সাথে | এইখানে মাত্র পাঁচটা আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করা গেল, পরে
সুযোগমতো বাকিগুলো নিয়েও আলোচনা করা যাবে |
___________________________
অর্ঘ্য দাস, দুর্গানগর, ৪-১১-২০১৫, (তথ্যসূত্র – ইন্টারনেট)
Comments
Post a Comment