Skip to main content

বিষয় : গোমাংস


আজকাল গো-মাংস নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে | রোজ রোজ নানা রকম খবর শোনা যাচ্ছে | একদল মানুষ গো-মাংস নিষিদ্ধ করে রাজনীতি করছে তো অন্যদল গো-মাংস খেয়ে প্রতিবাদী রাজনীতি করছে | দাদরি কান্ডের স্মৃতি এখনো দগদগে | এর উপর সম্প্রতি এক ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা নেতা হুমকি দিয়েছেন যে কর্ণাটকের মুখ্যমত্রী যদি গো-মাংস খান তাহলে তাকে নাকি হত্যা করা হবে !

আমার একটা বেসিক প্রশ্ন আছে – গরু কে হিন্দু ধর্মে পূজা করা হয় বলে তার মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বলে বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করছেন | খুব ভালো কথা | কিন্তু হিন্তু ধর্মে তো বরাহ (শুয়োর), কুর্ম (কচ্ছপ) ও মৎস্যকেও অবতার বলে ধরা হয় | তাহলে তাদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয় কেন ?

এই প্রশ্ন এক সাচ্চা হিন্দুকে করায় সে উত্তর দিয়েছিল, বাকি তিনটি জীবের থেকে গোরুর পার্থক্য হল যে আমরা গোরুর দুধ খাই, ফলে গোরু আমাদের মায়ের সমান, তাই তাকে খাওয়া মহাপাপ | ভালো যুক্তি নিঃসন্দেহে, কিন্তু আজকালকার এই দুর্মূল্যের বাজারে গোরুর খাঁটি দুধ কে খেতে পাচ্ছে কে জানে !! সবই তো সিন্থেটিক দুধ | সেই হিসাবে তো আর গো-জাতি আমাদের (অন্ততঃ শহুরে মানুষদের ক্ষেত্রে) মা হবার দাবি রাখতে পারে না ! jokes apart, আমার প্রশ্ন হল, সেদিক থেকে দেখতে গেলে তো মনুষ্য সমাজের অন্তর্গত সমস্ত নারীজাতিটাই আমাদের মায়ের সমান, তাহলে তাদের অসম্মান, হত্যা কেন পাপ নয় ? কেন হিন্দুত্ববাদীরা কোনো ইভটিজার বা ধর্ষণকারীকে হত্যার হুমকি দেয়না ? বা যে মেয়েটাকে honour killing-এর নামে হত্যা করা হয়েছে তার বাবা-দাদাকে ?

তাছাড়া কোনো খাবার খেলে কি করে ধর্মনাশ হয় সেটাও ভাববার বিষয় | আমি নিজে একবার গো-মাংস খেয়েছি, ক্লাস ইলেভেনে পড়তে | (আমার ধর্মনাশ হয়েছে কিনা জানি না , অন্ততঃ নিজে বুঝিনি |) চমৎকার খেতে, মাটনের থেকে প্রায় কোনো প্রভেদ নেই, অথচ দামে অনেক সস্তা | গরিব দেশ ভারতবর্ষের গরিব দেশবাসীর কাছে অনেক বেশি সহজলভ্য | সেই মাংস নিষিদ্ধ করলে আখেরে মানুষেরই অসুবিধা বেশি | ধর্মরক্ষার থেকেও জীবনধারণের তাগিদ বেশি | ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্মের সৃষ্টি | “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই |” মাদার টেরেসা বলেছিলেন, “তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালবাসতে না পারো তবে অদৃশ্য ঈশ্বরকে করে ভালবাসবে ?”

                                                                                                    চিত্রঋণ : ইন্টারনেট
গোরুকে একটু কম ভালোবেসে সেই ভালবাসাটা মানুষের মধ্যে বন্টন করলে বোধহয় দেশের বেশি ভালো হত | এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করছি | এটা কদিন আগে ফেসবুকেই পড়েছি | ঘটনাটা এরকম - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে দেখা করতে এসেছেন ‘গোরক্ষিনী সভা’র এক সদস্য, হাতে একখানা গোরুর ছবি | জানালেন, দেশের সব ‘গোমাতা’দের কসাইদের হাত থেকে রক্ষা করা; রুগ্ন, অকর্মণ্য গোরুর সেবা করাই তাঁদের ব্রত | বিবেকানন্দ বললেন, সে ঠিক আছে, কিন্তু মধ্য ভারতে দুর্ভিক্ষে নয় লক্ষ মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের সাহায্যে আপনারা কিছু করছেন না ?” লোকটি বললেন, না, তাঁরা শুধু গরুদের জন্যই কাজ করে থাকেন | তা ছাড়া, দুর্ভিক্ষ হয়েছে লোকের কর্মফলে, তাঁরা কি করবেন ? বিবেকানন্দ বললেন, “তবে তো এ-ও বলা যায় যে গোমাতারাও নিজ কর্মফলেই কসাইয়ের হাতে মরছেন !” থতমত খেয়ে লোকটি বললেন, “তা বটে, কিন্তু শাস্ত্রে বলে, গরু আমাদের মাতা |” সহাস্য স্বামীজির জবাব, “তা বটে, নইলে এমন সব কৃতি সন্তান আর কে প্রসব করবেন !!”

                                                                                                                                                           চিত্রঋণ : ইন্টারনেট 

আরেকটা ঘটনা বলি, এটিও স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কিত | ঘটনাটি শিকাগো ধর্ম মহাসভার | সেখানে প্রথম সেশনের পর বিরতিতে ধর্ম মহাসভার প্রেসিডেন্ট রেভারেন্ড ডঃ জন হেনরি বরোস স্বামী বিবেকানন্দ সহ অন্যান্য এশীয়দের আমন্ত্রণ করে আর্ট বিল্ডিং-এর বেসমেন্টে অবস্থিত এক রেঁস্তোরায় নিয়ে যান | এরপর সাহেবের নিজের ভাষায় – “I said to Swami : what shall I give you to eat ?” and he answered: “give me beef.” This simple remark was a thunder-bolt out of a clear sky. It changed the aspect of the whole meeting, and there were no further remarks about meat eating.   

                                                                                                                                                           চিত্রঋণ : ইন্টারনেট

   আসলে কোনো জিনিস খাওয়ার সাথে ধর্মের কি যোগ আছে সেটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না | যার যেটা ভালোলাগে সে সেটা খাবে আর তার যে ধর্ম ভালোলাগে সে তার পালন করবে | এই খাওয়া আর ধর্মাচারণ – দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস | এদের দ্বন্দ্ব হওয়াই উচিত নয় | একজন গোমাংস খেলে অন্যের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগবে এই যুক্তি একদম নিরর্থক | আর এই মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি গোমাংস ভক্ষণকারীকে পাল্টা আঘাত করবে – এটাই বা কোন ধরনের যুক্তি ? এটা তো ঐরকম ব্যাপারই হল – শার্লে এব্দো ম্যাগাজিনের কার্টুন কোনো একদল মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানলো আর তারাও বদলা নিতে ম্যাগাজিনের অফিসের মানুষগুলোর উপর আঘাত হানলো | 

                                                                                                                                                           চিত্রঋণ : ইন্টারনেট

বস্তুতঃ ধর্ম জিনিসটাকেই আমার ধোঁকার টাটি বলে মনে হয় মাঝেমাঝে | ওটা একদল মানুষের অন্যের উপর ছড়ি ঘোরানোর হাতিয়ার মাত্র | জগতের কল্যানের জন্য আস্তিক হবার কোনো দরকার নেই | পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, “It is not necessary to believe in God to be a good person. In a way, the traditional notion of God is outdated. One can be spiritual but not religious. It is not necessary to go to church and give money. For many, nature can be a church. Some of the best people in history did not believe in God, while some of the worst deeds were done in His name.”

                                                                                                                                                           চিত্রঋণ : ইন্টারনেট

পুনশ্চঃ- (১) তবে ধর্মতলার মোড়ে ঢাক পিটিয়ে গোরু খেয়ে প্রতিবাদ করারও কোনো দরকার নেই | বিজ্ঞাপন দিয়ে বিফ-পার্টির আয়োজনও নিষ্প্রয়োজন | ওটাও রাজনীতি | ‘প্রতীকি প্রতিবাদ’ – এসব হল বানানো কথা | শাসকদল গোমাংস ব্যান করছে বলে বিরোধী পার্টি প্রকাশ্যে বীফ খাচ্ছে | নামটাই যখন ‘বিরোধী দল’ তখন বিরোধিতা না করলে বড্ড খারাপ দেখায় ! সাধারণ মানুষের ভালো ওই বিরোধী পার্টির রাজনীতিকরাও চান না, এই সব বিক্ষোভ-বিরোধিতা হল তাদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার মাত্র |

                                                                                                                                                                 চিত্রঋণ : ইন্টারনেট
         
      (২) ইন্টারনেট থেকে পাওয়া একটা মজাদার ছবি এখানে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না-

                                                                                                                            চিত্রঋণ : ইন্টারনেট


________________
© অর্ঘ্য দাস

দুর্গানগর, ০৪-১১-২০১৫ 

Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...
  ঝাড়গ্রাম : বসন্ত ১৪২৭ স্কুল পাশ করেছি সতেরো বছর হয়ে গেল | তারপর এই প্রথম আমার সুযোগ হলো স্কুলের বন্ধুদের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার | দু তিনটে জায়গা মাথায় ছিল – ঘাটশিলা , ঝাড়গ্রাম, অযোধ্যা পাহাড় | এই বসন্তের শুরুতে তিনটে জায়গাই মনোরম | শেষমেষ ঝাড়গ্রাম WBFDC এর গেস্ট হাউসের ছবি দেখে সেটাই ফাইনাল করা হলো | 6 ই মার্চ, 2021, শনিবার          ডিমসেদ্ধ : সকাল সাড়ে দশটা - ক্যালেন্ডারে মার্চের শুরু হলেও বেজায় গরম. আমি দরদর করে ঘামছি ডেবরা চৌমাথায় (পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) দাঁড়িয়ে, হাতে আমার একুশটা হাঁসের ডিম সেদ্ধ, সাথে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি এবং সাদা ও কালো নুন | এক সপ্তাহ আগে করা প্ল্যান অনুযায়ী আমরা নাকি আগামী দু’ ঘন্টায় গাড়িতে বসে পার হেড পাঁচটা করে হাঁসের ডিম খাবো | ওদিকে সৌমাভ ওর গাড়িতে গোল (সুমিত্র) আর পকাই (অর্ক) কে নিয়ে আসছে কলকাতা থেকে |          বব মার্লে : শেষমেষ আমায় প্রায় ঘন্টা খানেক রোদে দাঁড় করানোর পর তাঁরা এলেন এবং বসন্তের এই অকাল দাবদাহ থেকে আমায় মুক্তি দিলেন | ঠান্ডা গাড়িতে উঠে ওদের আনা এগ স্যান্ডউইচ আর কোলাঘাট KFC থেকে কেনা মুর...