আমরা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন গড়ফা নামক জায়গায়
একটি মেসে থাকতাম | এই
মেসসূত্রেই পাঁচুর সাথে আমাদের আলাপ | পাঁচুর ভালোনাম একটা
আছে বটে, কিন্তু সেটা দীর্ঘদিনের অব্যবহারে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে | পাঁচুর বাড়ি কাটোয়ায়, সেখানে পাঁচুর বাবার একটা
খাবারের হোটেল আছে | পাঁচুর বাবা দক্ষ ব্যবসায়ী, ফলে এই হোটেল চলে খুব ভালো | ছুটিছাটায় বাড়ি গেলে
পাঁচুও মাঝেমাঝে এই হোটেলের ম্যানেজারি সামলায়, ফলে
হোটেল-ব্যবসার নাড়ি-নক্ষত্র পাঁচুরও জানা আছে | সেই
ট্রেড-সিক্রেটের কিছুটা পাঁচু আমাদের কাছে ফাঁস করেছিল | পাঁচুর
বলা চার আনা ঘটনার সাথে আমরা বারো আনা জল মিশিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে এমন রূপ
দিয়েছিলাম যে একটা সময়ের পরে পাঁচু এই বিষয়ে আমাদের সামনে মুখ খোলাই বন্ধ করে
দিয়েছিল | কিন্তু পাঁচু কে উত্ত্যক্ত করবার জন্য আমরা
মাঝেমাঝেই এই প্রসঙ্গের অবতারণা করে থাকতাম এবং আজও সবাই একজায়গায় জড়ো হলে এই
ব্যাপারে কথা উঠবেই |
শেষমেশ পুরো ব্যাপারটা কেমন দাঁড়িয়েছে সেটা আপনাদের বলি |
পাঁচুর বাবা বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের ভাবধারায় বিশ্বাসী | তাই হোটেলের নাম দিয়েছেন ‘আদর্শ বিন্দু
হোটেল’ | বিন্দুর যেরকম কেবলমাত্র অস্তিত্ব আছে কিন্তু
দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা কিছুই নেই, সেরকমই এই হোটেলের মাছের
পিসগুলো ‘আছে কিন্তু নেই’ গোছের অস্তিত্বহীনতায় ভোগে | শোনা
গেছে এই মাছগুলো কাটার সময় ছুরি-বঁটির পরিবর্তে শেভিং ব্লেড ব্যবহার করা হয় | কাটোয়া শহরের এক বিখ্যাত নাপিতকে পাঁচুর বাবা নিজের হোটেলে ভালো
মাইনে দিয়ে এনে রেখেছেন, এই নাপিতের কাজ হল সকাল বিকাল মাছ
কাটা | আজকাল বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে 3D সিনেমা দেখার সময় যেমন দর্শককে কিছু সিকিউরিটি মানির বিনিময়ে বিশেষ চশমা
ভাড়া দেওয়া হয়, সেরকমই এই হোটেলে মাছভাত খেতে ইচ্ছুক
কাস্টমারকে একটি করে ক্ষুদে মাইক্রোস্কোপ ধার দেওয়া হয় | সেই
যন্ত্র চোখে লাগিয়ে ওই আনুবীক্ষণিক মাছকেও পেল্লায় সাইজের মনে হয় | কাস্টমারেরও মন ভরলো, দোকানদারেরও পকেট ভরলো | মাংসের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য |
পাঁচুর বাবা বাজার থেকে আলাদা করে অর্ডার দেওয়া ক্রেট-ভর্তি
পুঁচকে ডিম নিয়ে আসেন | ডিমের
সাইজের জন্যই দাম অনেক কম পড়ে | এত ছোট ডিম কি করে তৈরী হয়
তা রীতিমতো ভাবনার বিষয় | আমাদের ধারণা জন্মনিরোধক ব্যবস্থা
নেওয়ার পর মোরগ-মুরগীর মিলনে ওই ডিম তৈরী হয় |
পাঁচুদের হোটেলে কখনোও পচা ডিম ফেলে দেওয়া হয়না | পচা ডিমের সাথে একটু রসুন-বাটা আর খাই সোডা
মিশিয়ে ভালো করে লঙ্কা-পেয়াঁজ দিয়ে ওমলেট বানিয়ে দিলে তাতে আর পচা গন্ধটা থাকেনা | এছাড়াও ডিম-তরকা বানাতেও ওসব কাজে লাগে |
পাঁচুর বাবার হোটেল সন্ধ্যার পরেই হোটেল-কাম-বার হয়ে যায় | তবে তা আইনমাফিক ভাবেই, পাঁচুর বাবার আবগারী দপ্তরের লাইসেন্স নেওয়া আছে | ঢুকুঢুকু-দের
জন্য হোটেলের ভিতরের দিকে আরেকটা কামরা আছে | সেখানে
সন্ধ্যার পর থেকেই মাছভাজার খুব চাহিদা | বিকাল নাগাদ
পাঁচুদের হোটেলের লোক বাজারে গিয়ে সস্তায় পচা মাছ কিনে নিয়ে আসে | কড়া করে ভাজলে মাছের পচা ভাবটা প্রায় কেটে যায় | শুরুর
দিকের এক-দু’ পেগের সাথে ভালো মাছ ভাজা পরিবেশন করা হয়, তারপর
কাস্টমারের একটু নেশা চড়ে গেলেই তখন তাকে পচা মাছ ভাজা দেওয়া হতে থাকে | এছাড়াও মাছের পিস-সংখ্যা নিয়েও কারচুপি করা হয় | নেশার
ঘোরে ক’জনেরই বা অত খেয়াল থাকে ?
এভাবে রমরমিয়ে চলছে পাঁচুদের হোটেলের ব্যবসা | পাঁচু তো আমাদের নেমন্তন্ন করেই রেখেছে | যদি কোনদিন কাটোয়া যাই তাহলে ভাবছি একবার ঢুঁ মেরেই আসবো ওখানে |
__________________
© অর্ঘ্য দাস
দুর্গানগর, ১৪-১০-২০১৫
Comments
Post a Comment