"I am always astonished by a forest. It makes me realize that the fantasy of nature is much larger than my own fantasy. I still have things to learn." - Gunter Grass
ভূমিকা :
আমাদের দেশের
উত্তর-মধ্য ভাগে, মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী জেলায় ‘মাধব ন্যাশনাল পার্ক’ নামে একটি
অখ্যাত জঙ্গল আছে | করবেট-রণথম্বর-বান্ধবগড়-কানহা-কাজিরাঙ্গা-গীর ইত্যাদি কুলীনদের
তুলনায় সে নিতান্তই ব্রাত্য, কারণ এই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ-হাতি-গন্ডার কোনটাই নেই | ফলে
যে সমস্ত পর্যটক হিংস্র শ্বাপদ দর্শনকেই জঙ্গলযাত্রার একমাত্র মাপকাঠি মানেন
তাঁদের এই জঙ্গল কখনোই ভালো লাগবে না | তবে জঙ্গলের নিজস্ব নৈসর্গিক রূপের সন্ধানে
যদি কোনো পর্যটক সেখানে গিয়ে হাজির হন তাহলে হয়তো তিনি নিরাশ হবেন না | আর তিনি যদি এখানকার সরকারী বনবাংলোয় একটা রাত থাকতে পারেন, তাহলে এই জঙ্গলভ্রমণ তাঁর সারাজীবনের এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে |
কর্মসূত্রে আমি
মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র শহরে সাড়ে তিন বছর ছিলাম – 2011 সালের জুলাই থেকে 2015 সালের জানুয়ারী অবধি | এই মাধব ন্যাশনাল পার্ক গোয়ালিয়র থেকে মাত্র 110 কিলোমিটার
দূরে | কোনো এক সপ্তাহান্তে হঠাৎ করেই ওখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম | সেবার জায়গাটাকে এত
ভালো লেগে যায় যে পরে এই জঙ্গলে আরো তিনবার গিয়েছি | প্রতিবারেই ওখানকার সরকারী বনবাংলোতে রাত্রিবাস
করেছি - জঙ্গলের
রাতের রূপ না দেখলে যে জঙ্গল-দর্শন বৃথা !!
বাঘ নেই কেন ?
আজ
এই জঙ্গলে কোনো বাঘ নেই এটা সত্যি, তবে কোনকালেই যে এই জঙ্গলে বাঘ ছিল না তা নয় ; বরঞ্চ ইতিহাস তার উল্টোটাই বলছে | অতীতে এই অঞ্চল বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর প্রাচুর্যের
জন্য বিখ্যাত ছিল | একসময় এই জঙ্গল ছিল গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজবংশের ব্যক্তিগত
শিকারক্ষেত্র (Private game reserve) | তারও আগে, মুঘল আমলে, এই অঞ্চল ছিল মুঘল
সম্রাটদের শিকারস্থল | 1916 সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ এখানে একদিনে আটটা বাঘ মেরেছিলেন
! লর্ড মিন্টো তার গোয়ালিয়র সফরে শিবপুরীর জঙ্গলেই 19 টা বাঘ মেরেছিলেন | সিন্ধিয়ারাও কম শিকার করেননি, গোয়ালিয়রে অবস্থিত সিন্ধিয়াদের মিউজিয়াম ‘জয় বিলাস
প্যালেসে’ গেলে মরা বাঘের পাশে বন্দুক হাতে বিজয়দর্প ভঙ্গিতে দাঁড়ানো পুরোনো
সিন্ধিয়া রাজাদের অনেক ফটো দেখতে পাওয়া যায় | এর পাশাপাশি চোরাশিকারীরাও রয়েছে | এইভাবে মানুষের নির্বিচার অত্যাচারের ফলে 1970 সাল নাগাদ এই জঙ্গল বাঘ-শূন্য হয়ে
যায় | হবারই কথা |
![]() |
লর্ড হার্ডিঞ্জ শুধু বাঘ মেরেই ক্ষান্ত হননি – রীতিমতো ফলক টাঙিয়ে জাহির করেছেন যে এখানেই তিনি একটি 11 ফুট 6 ইঞ্চি লম্বা বাঘ মেরেছিলেন | (চিত্রঋণ – ইন্টারনেট) |
জঙ্গল এবং লেকদ্বয় :
পাহাড়-জঙ্গল-জলাধার-তৃণভূমি
সমন্বিত এই বনাঞ্চল 358 বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত | 1958 সালে এই জঙ্গল জাতীয় উদ্যানের
স্বীকৃতি পায় | এই জঙ্গলের ভিতর দুটি কৃত্রিম জলাধার আছে - সখ্যসাগর লেক
(আয়তন 309 হেক্টর) ও মাধবসাগর লেক (আয়তন 40 হেক্টর) | দুটি লেকই 1918 সালে গোয়ালিয়রের
রাজা মাধব রাও সিন্ধিয়ার আমলে নির্মিত হয়, 'মনিহার' নদীর উপর বাঁধ দিয়ে |
উপরের ছবিটা জঙ্গলের একদম মাঝখানে অবস্থিত জর্জ ক্যাসেলের উপর থেকে তোলা | সামনে M-আকৃতির 'মাধব সাগর লেক' আর তার পিছনে 'সখ্য সাগর লেক' | পিছনের ওই সখ্য সাগর লেকের ধার ঘেঁষেই অবস্থিত
বনদপ্তরের বাংলো | ওই বাংলো থেকে সামান্য দূরেই (হাঁটাপথে দশ মিনিট)
জঙ্গলের মূল প্রবেশদ্বার |
'ভাদইয়া কুন্ড’:
জঙ্গলের মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে, একদম
জঙ্গলের গা ঘেঁষেই রয়েছে 'ভাদইয়া কুন্ড' | জঙ্গলে ঢোকার আগে সবাই এখানকার পুরোনো মন্দিরে একটু ঢুঁ মেরে যায় | আধ্যাত্মিক
মহিমার কথা বলতে পারব না, তবে জায়গাটা বেশ সুন্দর, এখান থেকে মূল জঙ্গলের অনেকটা
দেখা যায় | এর সীমানা ঘেঁষেই রয়েছে সখ্যসাগর লেক | এখান থেকে ওই যে দূরে দেখা
যাচ্ছে (নীচের ছবি দেখুন) লেকের ধারে দুটো বাড়ি - 'সেলিং ক্লাব' আর 'ব্যান্ড
স্ট্যান্ড' |
সেলিং ক্লাব :
জঙ্গলের মূল গেট দিয়ে ঢুকে গাড়িতে মিনিট পাঁচেক
এগোলেই বা হাতে পড়বে ‘সেলিং ক্লাব’ | এই জঙ্গলে
বনদপ্তরের গেস্ট হাউস বর্তমানে মোট তিনটে বাড়ি নিয়ে –'সেলিং ক্লাব’, 'ব্যান্ড
স্ট্যান্ড' আর ‘লেডিজ ক্লাব’ | ‘সেলিং ক্লাব’ (Sailing club) হল মূল ভবন | এই বিল্ডিংয়ের মধ্যে রয়েছে বনবাংলোর অফিসঘর, ডাইনিং রুম,
বিশাল খোলা বারান্দা আর দুটো VIP Suite যেগুলো সাধারণ পর্যটকের পক্ষে পাওয়া প্রায়
অসম্ভব | বছরের প্রায় সব সপ্তাহান্তেই মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সরকারী বড়কর্তা বা
জঙ্গলের আধিকারিকদের রুম বুক থাকে এখানে |
সেলিং
ক্লাবের ফটক
|
সেলিং ক্লাবের ভিতরে ঢুকেই বাঁ-দিকে বনবাংলোর অফিসঘর, ডান দিকে খাবার ঘর আর সামনে একটু হেঁটে গেলেই আপনি গিয়ে পৌঁছবেন সুবিশাল খোলা বারান্দায় |
সেলিং ক্লাবের বিশাল
বারান্দায় থেকে বিশাল লেক আর তার পিছনের জঙ্গলের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায় | এই বারান্দাটা খানিকটা ঝুলবারান্দা গোছের,
লেকের মধ্যে অনেকটা ঢুকে গেছে | নীচে জল, উপরে বিশাল খোলা বারান্দা | বর্ষার ভরা জলে
এই সেলিং ক্লাবের বাড়িটাকে খানিকটা হাউসবোটের মতো দেখায় | এখানে বসে সকাল-সন্ধ্যার
প্রকৃতির রূপ যদি কেউ একবার আস্বাদন করে থাকে, তাহলে সেই অভিজ্ঞতা সে সারাজীবনে
ভুলতে পারবে না |
নীচের লিঙ্কে ক্লিক করলে একটা 25 সেকেন্ডের ভিডিও দেখতে পাবেন, সেলিং ক্লাবের বারান্দা থেকে আমি এটা রেকর্ড করেছিলাম -
নীচের লিঙ্কে ক্লিক করলে একটা 25 সেকেন্ডের ভিডিও দেখতে পাবেন, সেলিং ক্লাবের বারান্দা থেকে আমি এটা রেকর্ড করেছিলাম -
‘ব্যান্ড স্ট্যান্ড’ গেস্ট হাউস :
সেলিং ক্লাবের পাশের ছোট বাড়িটার নাম 'ব্যান্ড
স্ট্যান্ড' | এখানে তিনটে রুম আছে | আমি যে চারবার বেড়াতে গিয়েছি তার
মধ্যে দু’বার ওখানে ছিলাম |
'ব্যান্ড
স্ট্যান্ড ' গেস্ট হাউসের সামনের দিক - এর পিছনেই রয়েছে
সখ্যসাগর লেক | |
গেস্ট
হাউসের ঘরে ঢুকে পিছনের দরজা খুলে দিতেই এই দৃশ্য চোখে পড়বে
|
ব্যান্ড স্ট্যান্ডের ঘরগুলোর চাহিদা বেশি, কারণ এই বাড়িটি সেলিং ক্লাবের লাগোয়া | ফলে বনবাংলোর অফিসার, কেয়ারটেকার, পাচক ও অন্যান্য কর্মীরা হাতের নাগালেই থাকেন | কাছেই রান্নাঘর, সেখানে রান্নাবান্নার ফাইফরমাস করা যায় | এছাড়াও চাকর-বাকর, পাহারাদারদের থাকার ঘরও একদম সামনেই | ফলে চারপাশে অনেক লোকজন থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কোনো ব্যাপার নেই | অন্যদিকে লেডিজ ক্লাবের বাড়িটা ভীষণ নির্জন পরিবেশে, সেলিং ক্লাব থেকে খানিকটা দূরে | রাতের বেলায় সেখানে অনেকেই থাকতে চাইবেন না | যদিও দু’জায়গার রুমভাড়া সমান, আমি শেষ গিয়েছি 2014 সালের অক্টোবরে, তখন ছিল 1000 টাকা |
'ব্যান্ড স্ট্যান্ড' রেস্ট হাউসের পিছন দিক | সেলিং ক্লাবের বারান্দা থেকে এই ছবি তুলেছি | সামনের দিক থেকে এই বাড়িটা দেখে একতলা বলে মনে
হলেও এই পিছন দিক থেকে দেখলে বোঝা যায় যে এটা আসলে দোতলা | বর্ষাকালে
একতলার অনেকটাই জলের তলায় চলে যায় |
|
ব্যান্ড স্ট্যান্ড বাড়িটির
রুমগুলো থেকে সখ্য সাগর লেকের দারুণ view পাওয়া যায় | চাঁদনী রাতে একটা চেয়ার টেনে
নিয়ে ব্যালকনিতে বসার অনুভূতি এক কথায় অনির্বচনীয় | শিবপুরীর এই জঙ্গল আমার ভীষণ
প্রিয় তার রাতের রূপের জন্য | চাঁদনী রাতে এই জঙ্গল যেন হয়ে ওঠে এক মায়াবী জগৎ | নিস্তব্ধতা আর নির্জনতার এক আশ্চর্য কোলাজ | সময়ও যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে |
![]() |
'ব্যান্ড
স্ট্যান্ড'এর বারান্দা | এখানে একটা চেয়ারে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা
কাটিয়ে দেওয়া যায় |
'ব্যান্ড স্ট্যান্ড'এর বারান্দায়
|
'লেডিজ ক্লাব' গেস্ট হাউস :
বনদপ্তরের গেস্টহাউসের তিন নম্বর বাড়ির নাম লেডিজ
ক্লাব | এটা বাকি দুটো বাড়ি থেকে একটু দূরে, জঙ্গলের দিকে | সেলিং ক্লাব থেকে
বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে মিনিট সাতেক হাঁটলে এখানে পৌছানো যাবে | অবস্থানগত কারণে বনদপ্তরের
বাকি বাড়িগুলো থেকে এই বাড়িটা দেখা যায় না | কোনো পাহারাদার বা চাকরও থাকে না এখানে | ফলে এই বাড়িটা একদমই বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন | জঙ্গলের
ভিতরে গা-ছমছমে রোমাঞ্চকর পরিবেশে যাঁরা থাকতে ভালবাসেন তাঁদের জন্য এই বাড়িই
আদর্শ | অন্যদিকে সপরিবারে আসা নিরাপত্তাপ্রিয় লোকজন বেশি পছন্দ করেন বাকি দুটো
বাড়ির কোনো একটায় ঠাঁই পেতে |
'লেডিজ ক্লাব' গেস্ট হাউস (সেলিং ক্লাবের দিকে থেকে তোলা ছবি)
|
'লেডিজ ক্লাব' থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকে মুড়ে এই নির্জন
রাস্তা ধরেই যেতে হবে সেলিং ক্লাবের দিকে | আশেপাশে শুধু
জঙ্গল | রাতের বেলায় এই রাস্তা দিয়ে একা
হেঁটে যেতে যথেষ্ট গা-ছমছম করে |
|
এই বাড়িতে দু’টো রুম আছে, আমি দু’বার এখানে থেকেছি | জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে এই বাড়ি বানানো হয়েছে | চারদিকে বেশ একটা বন্য পরিবেশ | তবে এই জায়গাটা
জঙ্গলের 'core area' থেকে অনেক দূরে, প্রায় জঙ্গলের শেষ সীমানাই বলা যায়, একটু দূর দিয়েই চলে গেছে ন্যাশনাল হাইওয়ে, ফলে এখানে হিংস্র বন্য জন্ত (বাঘ-সিংহ না থাকলেও
এই জঙ্গলে চিতা ও নেকড়ে আছে, অন্ততঃ মধ্যপ্রদেশ বনদপ্তর সেটাই জানাচ্ছে) আসার
সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে | তবে দিনের বেলা ময়ূর আর হরিণ ঘুরতে দেখেছি আশেপাশে |
লেডিজ
ক্লাব থেকে বেরিয়ে ডান দিকে গেলেই পড়বে এই রাস্তা - সামনেই জঙ্গল
|
জঙ্গলের
দিক থেকে 'লেডিজ ক্লাব' গেস্ট হাউসের ছবি
|
রাতের বেলায় এই বাড়ির চারদিকে
নিশ্ছিদ্র অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে | গেস্ট হাউসের বাইরের খোলা জায়গাটায় একটা সিমেন্ট
দিয়ে বাঁধানো বসার জায়গা আছে | রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর একবার ওই জায়গায় খোলা আকাশের
নিচে একা একা বসে ছিলাম অনেকক্ষণ | মনে হচ্ছিল যেন বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক
নির্জন দ্বীপে বসে আছি, শহরতান্ত্রিক সভ্যতার কোলাহল থেকে শত যোজন দূরে | গাছের
আড়ালে ঢেকে গেছে চাঁদের আলো | শব্দ বলতে
শুধু কানে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ার শিরশির শব্দ, কোনো নাম
না জানা রাতজাগা পাখির অস্ফুট ডাক আর মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতার উপর দিয়ে কোনো
জীবজন্তু বা সরীসৃপের চলাফেরার আওয়াজ – সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ | কিছুক্ষণ
পর আমাকে ওই রাতে ওখানে ওভাবে একা বসে থাকতে দেখে সঙ্গের লোকজন হৈহৈ করে উঠল, বলল ওখানে
বসে থাকা নাকি নিরাপদ নয়, আমি যেন তক্ষুনি ঘরে ফিরে আসি | কিন্তু আমায় তখন প্রকৃতি
নামক ‘নিশি’তে পেয়েছে, কোনো সাবধানবাণীই আমার মগজে ঢোকবার নয় !!
আরেকবার তো বাকিদের
রাজি করিয়ে আমরা সবাই মিলে বেরোলাম আশেপাশের বন-বাদাড়ে ‘night-walk’ করতে, রাত তখন
প্রায় এগারোটা হবে | সবাই জুতো পরে নিলাম, সঙ্গে টর্চ নিলাম | আর গাড়ির ড্রাইভারকে
বললাম আমরা যেদিকে যাব সেদিকে তাক করে যেন গাড়ির হেডলাইটগুলো জ্বালিয়ে রাখে | মিনিট
পাঁচেক হাঁটার পর গাছের আড়ালে গাড়ির আলো ঢেকে গেলে টর্চ জ্বালিয়ে পথ চলতে লাগলাম
আমরা | হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌছলাম একটা পরিত্যক্ত ‘ওয়াচ-টাওয়ারে’, সিঁড়ি বেয়ে তার উপরে
উঠে দেখলাম চাঁদের আলোয় জঙ্গলের রূপ | সে এক অদ্ভুত অনুভূতি !
ওয়াচ টাওয়ার
|
লেডিজ ক্লাবের দিকটা প্রাতঃভ্রমণের পক্ষেও
আদর্শ | আমি আদতে খুবই ঘুমকাতুরে, কিন্তু কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট
করার একদম পক্ষপাতী নই | শিবপুরীর এই জঙ্গলে যে ক’বার বেড়াতে গিয়েছি,
প্রতিবারই সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েছি হাঁটতে | জঙ্গলের দিকটায়
খানিকক্ষণ হেঁটে ওই ‘ওয়াচ-টাওয়ার’ অব্দি যাওয়া, ওখানে কিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘুরে আবার ফিরতি পথে
ফেরত আসা |
এবার আসি জঙ্গল
সাফারির কথায় | এখানে কোনো হুড-খোলা জিপসি ভাড়া পাওয়া যায় না, ফলে আমাদেরকে
প্রতিবারই নিজেদের গাড়িতে করে জঙ্গল ঘুরতে হয়েছে | তবে 5 কিলোমিটার দুরে অবস্থিত
শিবপুরি শহর থেকে জীপ ভাড়া করা যায় | আমি যেবার শেষ
ওখানে গিয়েছি, মানে 2014য়ের অক্টোবরে, তখন ওই জঙ্গলে চার চাকার গাড়ির প্রবেশ মূল্য
500 টাকা ও গাইড চার্জ 200 টাকা |
জঙ্গল সাফারির পথে |
the road less traveled |
আমার ভাগ্যে
জঙ্গল-সাফারিতে হিংস্র শ্বাপদ দর্শনের যোগ একদম নেই | আমি এতবধি বেশ কয়েকবার জঙ্গল
সাফারী করেছি – জিম করবেটে চার বার এবং সুন্দরবন, পেরিয়ার আর সিমলিপালে একবার করে – কোনবারেই বাঘ দেখার সৌভাগ্য হয়নি | শিবপুরীর জঙ্গলে বাঘ নেই মানছি, কিন্তু
চিতা-নেকড়ে-হায়না ইত্যাদি তো আছে ! অথচ এই
জঙ্গলে চার-চারবার সাফারী করেও তাদের টিকি দেখতে পাইনি | তবে নীলগাই, বন্য
শুয়োর, সাম্বার হরিন, চিতল হরিন, ময়ুর, বাঁদর, জংলী খরগোশ, বেজি, সারস, অনেক
নাম-না-জানা পাখি দেখেছি | আর দেখেছি কুমির, এই জঙ্গলে গেলে কুমির দেখা প্রায়
নিশ্চিত | জাল দিয়ে ঘেরা জায়গার কুমির নয়, এ একেবারে খোলা জায়গায় আপনার থেকে কয়েক
হাত দূরেই মূর্তিমান বিভীষিকা ! বনদপ্তরের হিসাবে এই সখ্যসাগর লেকে 200-250 কুমির রয়েছে !
নীলগাই
|
গভীর জঙ্গলে বসেছে হনুমানদের পঞ্চায়েত
|
বন্যেরা বনে সুন্দর
|
লেকের ধারে জল খেতে এসেছে বন্য শুয়োর
|
দিনের শেষে ঘরে ফেরা
|
বক এবং অ-বক জলপান
|
জর্জ ক্যাসেল :
উপসংহার :
বাঘ-সিংহহীন এই নাতি-বৃহৎ, রুক্ষ, অগভীর জঙ্গল অনেক মানুষের কাছেই তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু আমার সঙ্গে এই জঙ্গলের যেন নাড়ির টান | সেজন্যই বারে বারে হাজির হয়েছি সেখানে | সক্কাল-সক্কাল লেডিজ ক্লাবের দিকের জঙ্গলে পায়ে হেঁটে ঘুরতে যাওয়া, সন্ধ্যাবেলায় সেলিং ক্লাবের লেকমুখী বিশাল বারান্দায় বসে আড্ডা মারা, গভীর রাতে ব্যান্ড স্ট্যান্ডের বারান্দায় বসে রাত্রির নিস্তব্ধতাকে অনুভব করা – এই ছোট্ট ছোট্ট ভালোলাগার মুহূর্তগুলো ভোলার নয় | আজও প্রায় 1300 কিলোমিটার দুরে এই কলকাতায় বসেও মাঝে মাঝেই আমি মানসচক্ষে ঘুরে আসি শিবপুরীর ওই জঙ্গলে |
পুনশ্চঃ -
(1) সরকারী বনবাংলোয় থাকা-খাওয়ার গুণগত মান :
সরকারী বনবাংলোয় ঝাঁ-চকচকে রুম বা
24 ঘন্টা রুম সার্ভিস আশা করাই উচিত নয়, তবে এটুকু বলতে পারি যে এখানে থাকা-খাওয়ার
খরচ যেকোনো ট্যুরিস্ট স্পটের হিসাবে অপেক্ষাকৃত অনেক কম, ঘরগুলো বেশ বড়, সবকটা রুমই
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং সবচেয়ে বড় কথা – দুর্দান্ত লোকেশন |
খাবারদাবারের কথায় আসি - এটা তো আর বেসরকারী হোটেল বা
রিসর্ট নয়, ফলে মেনু খুবই সীমিত | আগে
এখানে মাংস রান্না হত, কিন্তু বর্তমানে জঙ্গলের বড়কর্তার নির্দেশে
সেটা বন্ধ হয়ে গেছে | তবে ডিমে কোনো বাধা নেই | (মাছের
প্রশ্নই নেই, কারণ এদিকে ওই জিনিসটার একদমই চল নেই) | রান্নাবান্না
ঘরোয়া হলেও যথেষ্ট স্বাদযুক্ত | আগে থেকে জানিয়ে দিতে হবে কি খেতে ইচ্ছা করছে, সেই
বুঝে ওরা বাজারঘাট করে রান্না করবে | বেশিরভাগ সময়ে আমাদের মেনু হত :
ভাত-রুটি-ডাল-ভাজা-তরকারী-ডিমের ঝোল-মিষ্টি | আর
টিফিনে লুচি-তরকারী, ওমলেট, আলুর
পরোটা, শীতকাল হলে ফুলকপির পরোটা – এই
সমস্ত পাওয়া যায় | আর সময়ে অসময়ে চা-বিস্কুট পাওয়া যাবে | মিনারেল
ওয়াটারও পাওয়া যায় | খাবার-দাবারের দাম যুক্তিসঙ্গত | সবমিলিয়ে
বন্দোবস্ত মোটেই খারাপ নয় |
তবে প্রথমদিকে একবার ওখানে মুরগীর মাংস খেয়েছিলাম | তখনো
ওখানে মাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি | সেবার পাচকের সঙ্গে কথা বলে আমাদের ড্রাইভারকে
জঙ্গল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের শিবপুরি শহরে পাঠিয়ে মাংস কিনে আনিয়েছিলাম | সেই
রান্নাটা জম্পেশ হয়েছিল | অত ভালো মাংসের ঝোল আমি খুব কমই খেয়েছি | মুখে যেন এখনো তার স্বাদ লেগে আছে !
(2)
বনদপ্তরের বাংলো বুক করার প্রয়োজনীয় তথ্য:
নীচের ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করলে বুকিং সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারবেন - http://mpforest.org/madhavnationalpark/Madhav%20Resort.htm
যদি
কোনভাবেই আগে থেকে সরকারী বনবাংলো বুক করা সম্ভব না হয়, তাহলে
ওখানে গিয়ে প্রথমেই সখ্যসাগর সেলিং ক্লাবের অফিসে যোগাযোগ করুন | আপনার বরাতজোরে যদি কোনো রুম খালি থাকে (সপ্তাহের মাঝখানে হলে সেই
সম্ভাবনাই বেশি), তাহলে স্পট-বুকিং করতে পারবেন |
আমার
সময়ে ওই অফিসের ইন-চার্জ ছিলেন 'মিঃ কোরকু' নামের এক ভদ্রলোক,
বেশ অমায়িক মানুষ, জানিনা এখনো তিনি দায়িত্বে
আছেন কিনা, তবু তাঁর মোবাইল নম্বর (এগুলোও পাল্টেছে কিনা
জানি না) এখানে দিচ্ছি, একবার কল করে দেখতে পারেন – 09691758388,
07492280422, 08269511185
(3) বনদপ্তরের বাংলো না পেলে
থাকবার বিকল্প ব্যবস্থা :
জঙ্গলের
সীমানার ঠিক বাইরে, সখ্য সাগর লেক যেখানে সরু হয়ে গিয়ে শেষ
হয়ে যাচ্ছে তার ধার ঘেঁষে, মানে পূর্বে উল্লিখিত 'ভাদইয়া
কুন্ড'র ঠিক পাশেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশ পর্যটন নিগমের ঝকঝকে তকতকে বেসরকারী
ট্যুরিস্ট ভিলেজ রিসর্ট | এখানে অনলাইনে বুকিং পাওয়া একেবারেই সহজ, বিলাসিতার
যাবতীয় উপকরণও এখানে মজুত | এখানে থাকলে দুটো বাড়তি সুবিধা আপনি পাবেন - (i) এরা খোলা জিপসিতে করে জঙ্গল সাফারি করায় (ii) এরা মোটর বোটে করে সখ্যসাগর লেক ঘুরিয়ে দেখায় | তবে এখানে থাকবার খরচ বেশ চড়া
এবং সরকারী বনবাংলোর সেই ‘বন্য আমেজ'টাই এখানে নেই | ওয়েবসাইট - Tripadvisor
(4) সিন্ধিয়াদের ছত্রী:
জঙ্গল থেকে ফেরার পথে শিবপুরী শহরে অবস্থিত 'সিন্ধিয়া রাজাদের ছত্রী' একবার দেখে নেবেন | বড়জোর আধঘন্টা সময় লাগবে | জায়গাটা বেশ সুন্দর |
জঙ্গল থেকে ফেরার পথে শিবপুরী শহরে অবস্থিত 'সিন্ধিয়া রাজাদের ছত্রী' একবার দেখে নেবেন | বড়জোর আধঘন্টা সময় লাগবে | জায়গাটা বেশ সুন্দর |
(5) এই জঙ্গল সারাবছরই খোলা থাকে, তবে বর্ষাকালই
জঙ্গলের রূপ উপভোগ করার আদর্শ সময় | এই
রুক্ষ জঙ্গল সেসময় ‘সুজলাং
সুফলাং’ হয়ে ওঠে | তবে
জঙ্গলের আবহাওয়া সবচেয়ে মনোরম থাকে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত
| জঙ্গল সাফারির সময় : সকাল 6 টা থেকে বিকাল 6 টা (সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত
পর্যন্ত ) | সূর্যোদয়
আর সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়েই সাফারিতে জন্তু-জানোয়ার দেখার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি
থাকে | পুরো
জঙ্গল সাফারিতে ঘন্টা দেড়েকের মত সময় লাগে |
(6) মাধব ন্যাশনাল পার্ক থেকে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালীয়র ও উত্তর প্রদেশের ঝাঁসি শহরদুটির
দুরত্ব যথাক্রমে 115 ও 95 কিলোমিটার | এই
জঙ্গলে আসতে হলে ওই দুটি শহর থেকেই গাড়ি করে আসা সবচেয়ে সুবিধাজনক | যদি
গোয়ালীয়র হয়ে এখানে আসেন তাহলে আসা বা যাওয়ার পথে ওই শহরের ‘গোয়ালীয়র ফোর্ট’ এবং
‘জয় বিলাস প্যালেস’ দেখতে ভুলবেন না | আর যদি ঝাঁসী হয়ে আসেন
তাহলে ঝাঁসীর লক্ষ্মীবাই-খ্যাত কেল্লা এবং ঝাঁসী থেকে অল্প দুরেই ‘ওরছা’ (orccha)
প্রাসাদ অবশ্যই দেখে নেবেন |
- অর্ঘ্য দাস @ টুকটাক লেখালেখি, দুর্গানগর
প্রথম লেখা : 02-10-2015
পুনর্লিখন : 19-01-2017
প্রথম লেখা : 02-10-2015
পুনর্লিখন : 19-01-2017
Gotokaal Bibhutibhoshoner "Aranyak" uponyas-ta shesh korlam. Aage pora hoini, shudhu jototuku HS-er syllabus-a chilo setukui jana chilo. Ei lekhar modhyeo aranyak-er choya pelam.
ReplyDeleteআরণ্যক উপন্যাসটা আমার পুরো পড়া হয়নি | নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষায় লিখিত অন্যতম সেরা উপন্যাস, তবু কেন জানি ওটা পড়লে নিঃসঙ্গতার একটা অনুভূতি আমাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে | তাই উপন্যাসটা একাধিকবার চেষ্টা করেও শেষ করতে পারিনি | তবে শিবপুরীর জঙ্গলে গেলে আমার সবার আগে ওই আরণ্যকের কথাই মনে পড়ত | অন্য জঙ্গলগুলোয় গিয়ে কিন্তু আমার সেরকম অনুভূতি হয়নি |
Deleteভালো হয়েছে .. তবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা ভুলে গেছ লিখতে মনে হচ্ছে | ওটা না শুনলে তো আবার মনে হয় যেন অর্ধেক ঘোরা হলো | :P
ReplyDeleteঠিক বলেছিস ! ব্যাপারটা জুড়ে দিয়েছি 'পুনশ্চঃ'-তে | পড়ে দেখ ....
DeleteConnectivity tao lekh..bes laglo..jayga ta dekhar ichhe roilo :)
ReplyDeleteওখানে গেলে একরাত কিন্তু থাকতে হবে গেস্ট হাউসে | নাহলে ব্যাপারটা জমবে না |
DeleteR jawar jonye kon samoy ta best
ReplyDeleteঠিক বলেছিস | ওই দুটো জিনিসও দেওয়ার দরকার | পুনশ্চ তে জুড়ে দিচ্ছি | :)
Deletetor lekha ta porei amar berate jete ichhe korche re!!!
ReplyDeleteGhure ay ekbar..... sob details to diyei diyechi.... erpor Corbett National Park niye likhbo next lekhata ... :) :)
Delete