Skip to main content

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৯ : মুড়ি-মাহাত্ম্য




নরেন্দ্রপুর মিশনে পড়াকালীন মুড়ি ছিল আমাদের জাতীয় খাদ্য | আমরা প্রথম দিনেই বিকালের টিফিন হিসাবে পেয়েছিলাম রসগোল্লা-মুড়ি, সঙ্গে একগ্লাস দুধ | কম্বিনেশনটা আমার কাছে একদম অপরিচিত ছিল, ফলে খেতে গিয়ে প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল | পরে অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছিল | মিশনে সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই বিকালের টিফিনে মুড়ি দেওয়া হত, কোনদিন সঙ্গে থাকত চালের পায়েস, কোনদিন বা সুজির পায়েস, কোনদিন চপ বা সিঙ্গাড়া আবার কোনদিন দেওয়া হত চানাচুর-পেয়াঁজ-লঙ্কা-ছোলা-সিদ্ধ আলুর কিউব সহযোগে মশলামুড়ি | আমাদের ব্যাচে বেশ কিছু মেদিনীপুর নিবাসী ছেলে ছিল, ভুরি ভুরি মুড়ি খেতে এদের জুড়ি ছিল না | ওদের মুড়ি খাওয়া দেখে আমাদের তাক লেগে যেত মাঝেমাঝে |

ক্লাস নাইন আর টেনে পড়াকালীন আমরা কয়েকজন ডাইনিং হল থেকে গ্লাসে বা পকেটে ভরে মুড়ি চুরি করে রুমে নিয়ে আসতাম | রাতে খাওয়াদাওয়ার পর 'Self-study' টাইমে মহা উৎসাহে ‘মশলামুড়ি উৎসব’ পালন করা হত | আমি তখন যোগানন্দ ভবনে থাকি, ২০০০-২০০২ সাল, হোস্টেল সুপার ছিলেন নাড়ু (নারায়ণ) মহারাজ | মহারাজ রোজ রাতে দশটা নাগাদ একবার রাউন্ড দিতে আসতেন, সেই ব্যাপারটাকে মাথায় রেখে রীতিমতো পালা করে একজনকে গার্ডে বসিয়ে রুমের মধ্যে মুড়ি মাখা হত | প্রায় নয়-দশ গ্লাস ভর্তি মুড়ি হত, সঙ্গে থাকত মা-বাবার দিয়ে যাওয়া চানাচুর, মেইন কিচেন বা ভবনের ডাইনিং হল থেকে চেয়েচিন্তে আনা পেয়াঁজ-লঙ্কা-শসা আর গায়ে মাখার সর্ষের তেল | ইম্প্রোভাইজেশনের জন্য কখনো কখনো মিশিয়ে দেওয়া হত ভাস্কর লবন, বা হজমি-চূর্ণ কিম্বা আচার | মুড়ি মাখার পাত্রের অভাব থাকায় স্নানের বালতিতেই মুড়ি মাখা হত | মশলামুড়ি মেখে বেশ নাম করে নিয়েছিলাম আমি সেই সময় | এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, যোগানন্দ ভবনের পাশেই একটা বাতাবি লেবু গাছ ছিল | সেই লেবু পেড়ে নুন-লঙ্কা-চিনি দিয়ে মেখে লেবুমাখাও অগুনতি দিন খেয়েছি | আর গরমকালে কালবৈশাখীর পরেরদিন আমমাখা তো ছিলই | সবকিছুই হত ওই রাতের সেলফ-স্টাডি টাইমে |

ওই সময়েই, মানে ক্লাস নাইন-টেনে পড়াকালীনই যেদিন বিকালে খেলতে যাওয়ার আগে স্ন্যাকস (Light tiffin) হিসাবে ফুচকা দেওয়া হত, সেদিন আমরা কয়েকজন খেলা থেকে ফিরে এসে টিফিনের (Heavy tiffin) বেল পড়ার আগেই ডাইনিং হলে গিয়ে হাজির হতাম | আসলে প্রতিদিনই কিছুটা ফুচকার আলুমাখা উদ্বৃত্ত থাকত, সেটা দিয়ে মুড়ি মেখে খেতে বড় ভালো লাগত | কিন্তু জিনিসটা খুব বেশি পরিমানে থাকত না, মানে প্রথম মাত্র নয়-দশ জনই সেটা পেত, সেজন্যই আগেভাগে দৌড়ে ডাইনিং হল যাওয়া |

ক্লাস ইলেভেনে ওঠার পর আমরা নরেন্দ্রপুর কলেজে ভর্তি হলাম, কারণ আমাদের সময়ে H.S. সেকশন কলেজের অন্তর্ভুক্ত ছিল | সেসময় সপ্তাহে একদিন ডিনারে আলুরদম দেওয়া হত | আমরা কয়েকজন খাওয়াশেষে আরো কিছুটা আলুরদম একটা গ্লাসে করে নিয়ে আসতাম | গভীর রাতে যখন খুব খিদে পেত, তখন ওই আলুরদমটা মুড়ি সহযোগে খেতাম | সেই স্বাদও ভোলার নয় |

মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমরা জনা বিশেক মিশনের বন্ধু মা-বাবা সমেত দীঘা বেড়াতে গিয়েছিলাম দু’ দিনের জন্য | প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক, ফলে আমরা একটা গোটা বাস ভাড়া করে নিয়ে গেছিলাম | সঙ্গে ছিল রান্নার লোক, গ্যাস-ওভেন সহ রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম | হোটেলের খাবার খেতে অনেকেরই আপত্তি থাকায় এই ব্যবস্থা | বাড়ি ফেরার পথে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল | ভোরবেলা শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা দিঘা থেকে রওনা দিয়েছি, ঘন্টা দুয়েক পরে গাড়ি থামানো হবে ব্রেকফাস্ট করার জন্য | ব্রেকফাস্টের জন্য সঙ্গে নেওয়া হয়েহে মুড়ি, চানাচুর আর চাট মশলা | আগেরদিন রাতে চিলি চিকেন অনেকটা বেঁচে গেছিল, সেটাকে না ফেলে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, প্ল্যান ছিল যে রাস্তায় ভিখারীদের দিয়ে দেওয়া হবে | যাইহোক, ঘন্টা দুয়েক পরে একটা রেস্ট হাউসের পাশে গাড়ি থামিয়ে ভিতরে ঢুকে মুড়ি মাখা হল | কিন্তু সকাল সকাল শুকনো মুড়ি চিবাতে কার আর ভালো লাগে ! সবাই কিরকম একটা মুখ ব্যাজার করে খেতে লাগলো | হঠাৎ একজন বলে উঠলো, “আচ্ছা, কালকের চিলি চিকেনটা বের করো তো, ওটা দিয়ে মুড়ি খেয়ে দেখি |” কয়েকজন হেসে উঠলো, ভাবটা এমন যে ওটা দিয়ে কি আর মুড়ি খাওয়া যায় !! যাইহোক, আস্তে আস্তে একজন দুজন করে বেশ কয়েকজন নিয়ে ফেলল চিলি চিকেন | তাদের তৃপ্তি ভরে মুখ চালাতে দেখে বাকিরা যেন নড়েচড়ে বসলো | এরপর কয়েক মিনিটে যা হল তাকে হরির-লুঠ বলাই চলে | কোথায় কোন ভিখারী, আমরা সবাই চেছেপুছে সব নিয়ে নিলাম | চিলি চিকেন দিয়ে মুড়ি যেন অমৃততুল্য বলে মনে হয়েছিল সেদিন |

এরকম করেই আমাদের সাথে মুড়ি বা মুড়ির সাথে আমরা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম মিশনে পড়াকালীন | মিশন ছাড়ার পর অনেকেই আমরা এই মুড়ি-প্রেম ত্যাগ করতে পারিনি | বরং এই অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দিয়ে মুড়ি খাওয়ার রোগটা সংক্রামিত করে দিয়েছি আরো অনেকের মধ্যে | যেমন  যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন যখন মেসে থাকতাম তখন অনেকদিন দুপুরের বেঁচে যাওয়া শুকনো তরকারী দিয়ে বিকালে মুড়ি মেখে খেয়েছি সবাই | প্রথমদিন আমাকে তরকারী দিয়ে মুড়ি মাখতে দেখে বাকিরা হেসেছিল, কিন্তু একবার ওই স্বাদ আস্বাদন করার পর ওরাও মুগ্ধ হয়ে গেছিল | এরপর থেকে ওই মুড়িমাখা খাওয়ার জন্য মেসে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত |  

এখনো বাড়িতে আমি মাঝেমাঝেই সয়াবিনের তরকারী কিম্বা বাঁধাকপির তরকারী দিয়ে মুড়ি মেখে খাই | কিম্বা দু’ পিস মাংস আর এক পিস আলু সহ মাংসের ঝোল দিয়ে | আমার এই অদ্ভুত খাওয়ার কাহিনী আমার আত্মীয়স্বজনদের একটা মজাদার আলোচ্য বিষয় | কিন্তু আমি এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হই না | লোকের কোথায় কান দিলে চলে না | পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছি, নিজের বাড়িতে এরকম উদ্ভট খাবার ট্রাই করতে সংকোচ বোধ হচ্ছে ? কুছ পরোয়া নেহি, আসুন না একদিন আমার বাড়িতে, আমার সাথে বসে চেখে দেখবেন | Open invitation রইলো |

© অর্ঘ্য দাস
দুর্গানগর, ১১-০৮-২০১৫

 


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...
  ঝাড়গ্রাম : বসন্ত ১৪২৭ স্কুল পাশ করেছি সতেরো বছর হয়ে গেল | তারপর এই প্রথম আমার সুযোগ হলো স্কুলের বন্ধুদের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার | দু তিনটে জায়গা মাথায় ছিল – ঘাটশিলা , ঝাড়গ্রাম, অযোধ্যা পাহাড় | এই বসন্তের শুরুতে তিনটে জায়গাই মনোরম | শেষমেষ ঝাড়গ্রাম WBFDC এর গেস্ট হাউসের ছবি দেখে সেটাই ফাইনাল করা হলো | 6 ই মার্চ, 2021, শনিবার          ডিমসেদ্ধ : সকাল সাড়ে দশটা - ক্যালেন্ডারে মার্চের শুরু হলেও বেজায় গরম. আমি দরদর করে ঘামছি ডেবরা চৌমাথায় (পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) দাঁড়িয়ে, হাতে আমার একুশটা হাঁসের ডিম সেদ্ধ, সাথে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি এবং সাদা ও কালো নুন | এক সপ্তাহ আগে করা প্ল্যান অনুযায়ী আমরা নাকি আগামী দু’ ঘন্টায় গাড়িতে বসে পার হেড পাঁচটা করে হাঁসের ডিম খাবো | ওদিকে সৌমাভ ওর গাড়িতে গোল (সুমিত্র) আর পকাই (অর্ক) কে নিয়ে আসছে কলকাতা থেকে |          বব মার্লে : শেষমেষ আমায় প্রায় ঘন্টা খানেক রোদে দাঁড় করানোর পর তাঁরা এলেন এবং বসন্তের এই অকাল দাবদাহ থেকে আমায় মুক্তি দিলেন | ঠান্ডা গাড়িতে উঠে ওদের আনা এগ স্যান্ডউইচ আর কোলাঘাট KFC থেকে কেনা মুর...