Skip to main content

বাজে গল্প ১ : দামোদর-চরিত

______________________________________________________________
দামু আমার মাসতুতো ভাই, ভালো নাম দামোদর, আমার থেকে বছর দশেকের ছোট, ‘খাইয়ে’ হিসাবে আত্মীয়মহলে বিশেষভাবে পরিচিত | বিশাল ভুঁড়ি না থাকলেও ভুরি ভুরি খাওয়ায় ওর জুড়ি নেই | দশাবতারের মধ্যে চারজন - মৎস্য, কুর্ম, বরাহ  এবং রাম (rum) - বহুবার আমার এই উদারচিত্ত ভাইটির উদরস্ত হয়েছেন | আরেক অবতার শ্রীকৃষ্ণকে ডাইরেক্ট বাগে না পেলেও কেশবের চানাচুর, কৃষ্ণ চন্দ্র দাস aka কে.সি.দাসের রসগোল্লা, গোপাল জর্দা এবং শ্যাম-পেন আমার এই ভাইটি মুখস্থ ও পেটস্থ করেছে | দামু খাসা ছেলে, খাসি ওর খাস পছন্দের জিনিস, সাতসকালেও বাসি মুখে হাসি নিয়ে রাশিরাশি খাসি খেতে ওর কোনো আপত্তি নেই | হাসতে হাসতে এক ডজন হাঁসের ডিম ভোজন করা, peacefully পনেরো পিস্ মাছ হাপিস করা কিংবা চুপচাপ গোটা পাঁচ চিকেন চাপ পেটের মধ্যে পাচার করা – কোনোকিছুতেই ওর জুড়ি নেই | প্লেটে ওমলেট, ‘কাটলেট’ ইত্যাদি পড়লে একটুও ‘লেট’ না করে বস্তুটি ‘কাট’ করে মুখের মধ্যে ‘পেস্ট’ করে দেয়, বুলেটের গতিতে ছুরি-কাঁটাচামচ চালিয়ে | এ রাজ্যে হেন কোনো মিঠাই নেই যা ওর পেটে ঠাঁই পায়নি ছুরি-কাঁটাচামচ চালাতে  শুধু এক অজানা কারণে মুড়ি ওর বিলকুল না-পসন্দ | সবথেকে আশ্চর্যের হল ঐরকম ফাঁসির আসামির শেষ খাওয়ার মতো পেটে অত কিছু ফাঁসিয়েও দামু বিন্দুমাত্র হাসফাঁস করেনা, রীতিমতো নির্বিকার ভাবে চলেফিরে বেড়ায়, যেন কিছুই হয়নি – কি করে ও এই অসাধ্য সাধন করে সেটা দামু আজও আমাদের কাছে সেটা ফাঁস করেনি |

আজকাল অনুষ্ঠানবাড়িতে একটা নতুন ফ্যাশান চালু হয়েছে, কম খাওয়ার | সেই আগেকার দিনের বাঙালীর কাছা খুলে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার দিন আর নেই | আজকাল ক্যাটারার কোম্পানিগুলোও খুব চালাকি শিখেছে, হাফ হাতা পোলাও, পালস্ পোলিওর ওষুধের মতো দু’ফোঁটা ডাল, আনুবীক্ষণিক দুই পিস মাটন, আধা স্কুপ আইসক্রিম - এইরকম করে সার্ভ করে | সবই বিজনেস পলিসি, চক্ষুলজ্জা এড়িয়ে কত বার আপনি চাইবেন ? বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানো হলে অনুষ্ঠানকর্তা তবুও একবার রাউন্ড দিয়ে যান কিন্তু আগেকার দিনের সেই “ওরে কে আছিস, অর্ঘ্যবাবুর থালায় কয়েকপিস মাছ দিয়ে যা” গোছের আন্তরিকতা আর নেই | বুঁফে হলে তো অতিথিদের খাওয়া দেখভালের কোনো ব্যবস্থাই নেই | এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের দামু কিন্তু বাঙালীর পেট ঠেঁসে খাওয়ার প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে | বুঁফে ওর ভারী পছন্দের জিনিস, প্লেট হাতে ও মাটনের কাউন্টারটার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে, মাঝখান দিয়ে একটা লোক গলবার জায়গাটুকু ছেড়ে | মন দিয়ে খায়, শেষ করে, এরপর খালি প্লেটটা বাড়িয়ে পরিবেশনকারীর দিকে একটা আজ্ঞাসূচক চাহনি দেয়, সন্তোষজনক পরিমান না দেওয়া অব্দি প্লেট সরায় না, প্লেট ভরলে আবার খাওয়ায় মন দেয় |ক্যাটারারের চালাকির কোনো জায়গা নেই,  যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল ! এই কদিন আগে বেহালার কাছে একটা জায়গায় বিয়েবাড়িতে গিয়ে দামু প্রায় ছোটোখাটো একটা আস্ত পাঁঠাই খেয়ে ফেলেছিল | অবশ্য সেটা ছাড়াও স্ন্যাকস বাবদ আধাকেজি চিকেন পকোড়া, শেষপাতে খান দশেক মিষ্টি আর খাওয়াশেষে গোটা পাঁচেক বেনারসি পানও যে খেয়েছিল তা বলাই বাহুল্য ! দামোদর শেঠের মতই আমাদের দামুও অল্পেতে খুশি হয় না !  

আরেক অভিজ্ঞতা হয়েছিল বছর খানেক আগে ‘বার্বিকিউ নেশন’ রেস্তোরায় গিয়ে | সস্ত্রীক আমি, আর দামু সহ আমার দুই মাসতুতো ভাই  – এই চার খাইয়ে মিলে বুঁফে লাঞ্চে গিয়েছি ওখানে | পতাকা তুলে স্টার্টার খেয়ে চলেছি তো চলেছি, সে যেন ‘খান্ডব দহন’ পর্ব, ঝলসানো মুরগি-পাঁঠা-মাছ-চিংড়ি নিয়ে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলা চলছে, বলার অপেক্ষা রাখেনা যে দামুই সেরা পারফরমেন্স দিচ্ছে | শেষে ওকে দেখে আমাদের রীতিমতো ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স চলে এল | খানিক পর দেখি ওয়েটারগুলো বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে | অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়ে পতাকা নামিয়ে মেইন কোর্স শুরু করলাম | এবার দামু খানিকক্ষণ সংযত থাকলেও শেষপাতে প্রায় কেজিখানেক মিনি গুলাবজামুন নিয়ে এল | আজও দামুর সাথে দেখা হলে আমাদের আড্ডায় একবার না একবার ঐদিনের প্রসঙ্গ তো আসবেই !

ইদানিং লোকমুখে শুনলাম দামু ওদের পাড়ার রাস্তায় বেরোলেই নাকি গরু-ছাগল-মুরগি-শুয়োর ইত্যাদিদের অলিখিত কার্ফু জারি হয়ে যাচ্ছে | ওকে দেখলেই যে যেখানে আছে ছুটে পালাচ্ছে, বোধহয় মৃত্যুভয়ে ! কি করে যেন ওরাও জেনে গেছে যে দামু হল ওদের যম | ব্যাপারটায় আমি কিন্তু মোটেও বিশ্বাস করিনি, তবু ভাবছি সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে একদিন ঘুরেই আসব ওদের বাড়ি থেকে |

পুনশ্চঃ- ভাই দামু, এই লেখাটা তোর পড়বার সম্ভাবনা খুবই কম, তবু যদি বাইচান্স পড়ে ফেলিস তাহলে আমার উপর রাগ করিস না | নেহাতই পাঠককূলের মনোরঞ্জনের জন্য এই লেখাটা লিখলাম, তাছাড়া তোর এই মারাত্মক প্রতিভা চিরকাল লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে যাবে সেটাও তো ভালো কথা নয় !!

© অর্ঘ্য দাস

দুর্গানগর, ১৪-০৪-২০১৫  

Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...
  ঝাড়গ্রাম : বসন্ত ১৪২৭ স্কুল পাশ করেছি সতেরো বছর হয়ে গেল | তারপর এই প্রথম আমার সুযোগ হলো স্কুলের বন্ধুদের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার | দু তিনটে জায়গা মাথায় ছিল – ঘাটশিলা , ঝাড়গ্রাম, অযোধ্যা পাহাড় | এই বসন্তের শুরুতে তিনটে জায়গাই মনোরম | শেষমেষ ঝাড়গ্রাম WBFDC এর গেস্ট হাউসের ছবি দেখে সেটাই ফাইনাল করা হলো | 6 ই মার্চ, 2021, শনিবার          ডিমসেদ্ধ : সকাল সাড়ে দশটা - ক্যালেন্ডারে মার্চের শুরু হলেও বেজায় গরম. আমি দরদর করে ঘামছি ডেবরা চৌমাথায় (পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) দাঁড়িয়ে, হাতে আমার একুশটা হাঁসের ডিম সেদ্ধ, সাথে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি এবং সাদা ও কালো নুন | এক সপ্তাহ আগে করা প্ল্যান অনুযায়ী আমরা নাকি আগামী দু’ ঘন্টায় গাড়িতে বসে পার হেড পাঁচটা করে হাঁসের ডিম খাবো | ওদিকে সৌমাভ ওর গাড়িতে গোল (সুমিত্র) আর পকাই (অর্ক) কে নিয়ে আসছে কলকাতা থেকে |          বব মার্লে : শেষমেষ আমায় প্রায় ঘন্টা খানেক রোদে দাঁড় করানোর পর তাঁরা এলেন এবং বসন্তের এই অকাল দাবদাহ থেকে আমায় মুক্তি দিলেন | ঠান্ডা গাড়িতে উঠে ওদের আনা এগ স্যান্ডউইচ আর কোলাঘাট KFC থেকে কেনা মুর...