______________________________________________________________
দামু আমার
মাসতুতো ভাই, ভালো নাম দামোদর, আমার থেকে বছর দশেকের ছোট, ‘খাইয়ে’ হিসাবে
আত্মীয়মহলে বিশেষভাবে পরিচিত | বিশাল ভুঁড়ি না
থাকলেও ভুরি ভুরি খাওয়ায় ওর জুড়ি নেই | দশাবতারের মধ্যে
চারজন - মৎস্য, কুর্ম, বরাহ এবং রাম (rum) - বহুবার আমার এই
উদারচিত্ত ভাইটির উদরস্ত হয়েছেন | আরেক অবতার
শ্রীকৃষ্ণকে ডাইরেক্ট বাগে না পেলেও কেশবের চানাচুর, কৃষ্ণ চন্দ্র দাস aka কে.সি.দাসের রসগোল্লা, গোপাল জর্দা এবং শ্যাম-পেন আমার এই ভাইটি মুখস্থ ও পেটস্থ করেছে | দামু খাসা ছেলে, খাসি ওর খাস পছন্দের জিনিস, সাতসকালেও
বাসি মুখে হাসি নিয়ে রাশিরাশি খাসি খেতে ওর কোনো আপত্তি নেই | হাসতে হাসতে এক ডজন হাঁসের ডিম ভোজন করা, peacefully পনেরো পিস্ মাছ হাপিস করা কিংবা চুপচাপ গোটা পাঁচ চিকেন
চাপ পেটের মধ্যে পাচার করা – কোনোকিছুতেই ওর জুড়ি নেই | প্লেটে ওমলেট, ‘কাটলেট’ ইত্যাদি পড়লে একটুও ‘লেট’ না করে বস্তুটি ‘কাট’ করে
মুখের মধ্যে ‘পেস্ট’ করে দেয়, বুলেটের গতিতে ছুরি-কাঁটাচামচ চালিয়ে | এ
রাজ্যে হেন কোনো মিঠাই নেই যা ওর পেটে ঠাঁই পায়নি ছুরি-কাঁটাচামচ চালাতে শুধু এক অজানা কারণে মুড়ি ওর বিলকুল
না-পসন্দ | সবথেকে
আশ্চর্যের হল ঐরকম ফাঁসির আসামির শেষ খাওয়ার মতো পেটে অত কিছু ফাঁসিয়েও দামু বিন্দুমাত্র হাসফাঁস করেনা, রীতিমতো নির্বিকার ভাবে চলেফিরে বেড়ায়, যেন কিছুই
হয়নি – কি করে ও এই অসাধ্য সাধন করে সেটা দামু আজও আমাদের কাছে সেটা ফাঁস করেনি |
আজকাল
অনুষ্ঠানবাড়িতে একটা নতুন ফ্যাশান চালু হয়েছে, কম খাওয়ার | সেই আগেকার দিনের বাঙালীর কাছা খুলে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার দিন
আর নেই | আজকাল ক্যাটারার কোম্পানিগুলোও
খুব চালাকি শিখেছে, হাফ হাতা পোলাও, পালস্ পোলিওর ওষুধের মতো দু’ফোঁটা ডাল, আনুবীক্ষণিক
দুই পিস মাটন, আধা স্কুপ আইসক্রিম - এইরকম করে সার্ভ করে | সবই বিজনেস পলিসি, চক্ষুলজ্জা এড়িয়ে কত বার আপনি চাইবেন ? বসিয়ে
পাত পেড়ে খাওয়ানো হলে অনুষ্ঠানকর্তা তবুও একবার রাউন্ড দিয়ে যান কিন্তু আগেকার
দিনের সেই “ওরে কে আছিস, অর্ঘ্যবাবুর থালায় কয়েকপিস মাছ দিয়ে যা” গোছের আন্তরিকতা
আর নেই | বুঁফে হলে তো অতিথিদের খাওয়া
দেখভালের কোনো ব্যবস্থাই নেই | এত প্রতিকূলতা
সত্ত্বেও আমাদের দামু কিন্তু বাঙালীর পেট ঠেঁসে খাওয়ার প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রেখে
চলেছে | বুঁফে ওর ভারী পছন্দের জিনিস,
প্লেট হাতে ও মাটনের কাউন্টারটার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে, মাঝখান দিয়ে একটা লোক গলবার
জায়গাটুকু ছেড়ে | মন দিয়ে খায়, শেষ করে, এরপর খালি
প্লেটটা বাড়িয়ে পরিবেশনকারীর দিকে একটা আজ্ঞাসূচক চাহনি দেয়, সন্তোষজনক পরিমান না
দেওয়া অব্দি প্লেট সরায় না, প্লেট ভরলে আবার খাওয়ায় মন দেয় |ক্যাটারারের চালাকির কোনো জায়গা নেই, যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল ! এই কদিন আগে
বেহালার কাছে একটা জায়গায় বিয়েবাড়িতে গিয়ে দামু প্রায় ছোটোখাটো একটা আস্ত পাঁঠাই খেয়ে
ফেলেছিল | অবশ্য সেটা ছাড়াও
স্ন্যাকস বাবদ আধাকেজি চিকেন পকোড়া, শেষপাতে খান দশেক মিষ্টি আর খাওয়াশেষে গোটা
পাঁচেক বেনারসি পানও যে খেয়েছিল তা বলাই বাহুল্য ! দামোদর শেঠের মতই আমাদের দামুও
অল্পেতে খুশি হয় না !
আরেক অভিজ্ঞতা
হয়েছিল বছর খানেক আগে ‘বার্বিকিউ নেশন’ রেস্তোরায় গিয়ে | সস্ত্রীক আমি, আর দামু সহ আমার দুই মাসতুতো ভাই – এই চার খাইয়ে মিলে বুঁফে লাঞ্চে গিয়েছি ওখানে | পতাকা তুলে স্টার্টার খেয়ে চলেছি তো চলেছি, সে যেন ‘খান্ডব
দহন’ পর্ব, ঝলসানো মুরগি-পাঁঠা-মাছ-চিংড়ি নিয়ে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলা চলছে, বলার
অপেক্ষা রাখেনা যে দামুই সেরা পারফরমেন্স দিচ্ছে | শেষে ওকে দেখে আমাদের রীতিমতো ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স চলে
এল | খানিক পর দেখি ওয়েটারগুলো
বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে | অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়ে পতাকা নামিয়ে মেইন কোর্স শুরু করলাম | এবার দামু খানিকক্ষণ সংযত থাকলেও শেষপাতে প্রায় কেজিখানেক
মিনি গুলাবজামুন নিয়ে এল | আজও দামুর সাথে
দেখা হলে আমাদের আড্ডায় একবার না একবার ঐদিনের প্রসঙ্গ তো আসবেই !
ইদানিং লোকমুখে
শুনলাম দামু ওদের পাড়ার রাস্তায় বেরোলেই নাকি গরু-ছাগল-মুরগি-শুয়োর ইত্যাদিদের
অলিখিত কার্ফু জারি হয়ে যাচ্ছে | ওকে দেখলেই যে
যেখানে আছে ছুটে পালাচ্ছে, বোধহয় মৃত্যুভয়ে ! কি করে যেন ওরাও জেনে গেছে যে দামু
হল ওদের যম | ব্যাপারটায় আমি কিন্তু মোটেও
বিশ্বাস করিনি, তবু ভাবছি সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে একদিন ঘুরেই আসব ওদের বাড়ি থেকে |
পুনশ্চঃ- ভাই দামু, এই লেখাটা তোর পড়বার সম্ভাবনা খুবই কম, তবু যদি বাইচান্স পড়ে ফেলিস
তাহলে আমার উপর রাগ করিস না | নেহাতই পাঠককূলের
মনোরঞ্জনের জন্য এই লেখাটা লিখলাম, তাছাড়া তোর এই মারাত্মক প্রতিভা চিরকাল
লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে যাবে সেটাও তো ভালো কথা নয় !!
© অর্ঘ্য দাস
দুর্গানগর,
১৪-০৪-২০১৫
Comments
Post a Comment