_____________________________________________________________________
দিনের শুরু :
ঢং ঢং ঢং … সাতসকালে চরম বিরক্তিকর সেই
Rising bell | সেই ভয়াবহ P.T.-র হাতছানি | মাঝখানে
গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ প্রায়শই হট ড্রিংকের জায়গায় চিরতার জলের আবির্ভাব,
সাতসকালেই অন্নপ্রাশনের ভাত বের করার সুনিশ্চিত বন্দোবস্ত | তারপর
জুনিয়রের প্রতুলদার সামনে দড়িলাফানো, কিংবা সিনিয়রের সন্তোষ সাহাদার সামনে
ফ্রগব্যালান্স-ধনুরাসন বা গম্ভীরমুখে অরুণদার ভাষণ শোনা (হেসেছ তো ফেঁসেছ, জুটবে
বেদম প্রহার) অথবা ক্যাম্পাস চক্কর দেবার সময় দুর্দান্তপ্রতাপ শরদ মিরানিদার চোখ
এড়িয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে শর্টকাটের চেষ্টা | সেইসময় মনে
হতো পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ হল তারা যাদের সেই মাসে ‘মর্নিং প্রেয়ার হল ওয়ার্কার’-এর
ডিউটি পড়ার সুবাদে পিটি অফ রয়েছে | পিটি থেকে কোনমতে প্রাণটুকু সম্বল করে ভবনে ফিরে
স্যাটাস্যাট কুমড়োর ঘ্যাটের মতো বিদ্যুতগতিতে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে প্রেয়ার হলে
প্রবেশ | যদিও এই প্রেয়ার হল ভবিষ্যতের বহু কৃতী শিল্পীর
(গাইয়ে-তবলচি-বাগ্মী) শৈশবের শিল্পসাধনার আঁতুড়ঘর, তবুও অধিকাংশ জনগনের কাছে ওটা
ছিল পিটির হাঁড়-ভাঙা খাটুনির পর ‘বসে ঘুমাও প্রতিযোগিতা’র খোলা ময়দান | নিতান্তই
ঘুম না এলে অনেক সময় আমরা সিনেমা আর্টিস্টদের মতো গানের সুরে ঠোঁট মেলাতাম, কিন্তু
গলা দিয়ে আওয়াজ বের গান করাটা আমরা নিতান্তই অকারণ শক্তিক্ষয় বলে মনে করতাম | সিনিয়র
সেকশনে গিয়ে অবশ্য প্রেয়ার হলটা অনেকের কাছেই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘স্টোরি বুক রিডিং
রুম’ - উত্তরিয়ের আঁড়ালে হ্যারি পটার বা সিডনি শেল্ডনের গোটা সিরিজ পড়ে শেষ করেছে
এমন বেশ কয়েকজন বইপোকা আমাদের ব্যাচে ছিল |
![]() |
অভেদানন্দ ভবনের প্রেয়ার হল, আমি তখন ক্লাস
সিক্সে পড়ি (১৯৯৭ সাল)
|
পরের গন্তব্যস্থল স্টাডি হল | ছোটবেলা থেকেই পড়ার ঘরে চুপচাপ পাঁচ মিনিট বসে
থাকলে বাবা হাঁক দিতেন, “কি করছিস চুপ করে ? চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পড় !” কেন জানি
আপামর বাঙালীর মনে এই কনসেপ্টটা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে জাঁকিয়ে বসেছে যে চিৎকার করে পড়লে পড়াটা ভালোভাবে
মাথায় ঢুকবে | জীবনে প্রথমবার এই কনসেপ্টের ভায়োলেশন দেখেছিলাম
নরেন্দ্রপুরের স্টাডি হলে, যেখানে চুপচাপ নিঃশব্দে পড়াশুনা করাটাই হল আইন,
বিন্দুমাত্র ট্যাঁ-ফুঁ করলে সাজা জুটবে একমাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি ! সকালবেলার
এই সময়টায় আমরা যে মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে পড়িনি বা বইয়ের আঁড়ালে গল্পের বই পড়িনি তা নয়,
তবে মোটের উপর এই সময়টায় আমরা মন দিয়েই পড়াশুনা করতাম |
![]() |
স্টাডি হল (চিত্রঋণ – রিয়াজুল হক)
|
জলখাবার :
ব্রেকফাস্টে আমরা ‘পাস’ পাবার জন্য কম খাইয়েদের পাশে বসতাম | যেমন ধরা
যাক সোমবার সকালে তেঁতুলজল মেশানো গোলমরিচ-আলুর
তরকারী আর পরোটা দেবে | তা
জেলখানার কয়েদীদের সবার রেশন তো ফিক্সড, দুটোর জায়গায় তিনটে পরোটা তো আর পাওয়া
যাবে না, সুতরাং স্টাডিহলেই আমরা ‘বুক’ করে রাখতাম সেই সব ছেলেদের যারা পরোটা ভালো
খায় না | আমার নিজস্ব সেরা পছন্দের জিনিস অবশ্য ছিল বৃহঃস্পতিবারের
সকালের ভাতভাজা আর আলুর তরকারী | রোববারের খিচুড়ি-পাঁপড়ভাজা বা ঘি আলুসিদ্ধ
সহযোগে ফ্যানভাতও মন্দ ছিল না !
![]() |
ডাইনিং হল
|
স্কুল – ফার্স্ট হাফ :
সিনিয়র স্কুলে এসেম্বলী পরবর্তী কয়েক ঘন্টা ছিল হেডমাস্টার মশাই অশোকদার
(স্বামী সত্যাত্মানন্দ)রাজত্ব | জুনিয়র স্কুলের সর্বেসর্বা ছিলেন তপন মহারাজ
(স্বামী আদিজানন্দ) কিন্তু অশোকদার মতো দোর্দণ্ড প্রতাপ তাঁর ছিল না, বোধহয় জুনিয়র
স্কুলে সেটার দরকারও ছিল না | সিনিয়র সেকশনে স্কুল চলাকালীন অশোকদা বহু বার
ক্লাসরুমের বাইরে দিয়ে পায়চারী করতেন আর সামান্যতম বেগড়বাই দেখলেই সেই ছাত্রকে
ক্লাসশেষে নিজের ঘরে ডেকে পাঠাতেন | স্কুলের চাপরাশি একটি ছোট চিরকুট নিয়ে আসত, তাতে
লেখা থাকত “অমুক, to see
me after the class” | ব্যাপারটা আমাদের কাছে ছিল মৃত্যু-পরোয়ানার সমান, লাল পর্দা সরিয়ে তাঁর অফিস
ঘরে ঢুকতে আমাদের মধ্যে সবথেকে সাহসী ছেলেরও বুক কেঁপে যেত | তবে অজিতদা-নিখিলদা-নারায়ণদা-বেনুদা-সচিনদা-শিশিরদা - এঁদের মতো শিক্ষকদের দৌলতে
স্কুলটাইমটা খারাপ কাটত না ! এরই মাঝে আমবাগানে শরদদার ড্রয়িং ক্লাস কিংবা
দিলীপদার গানের ক্লাস অথবা আমার অত্যন্ত পছন্দের সেই বুক-বাইন্ডিং ক্লাস (যেখানে
আমরা খিল্লি ছাড়া আর কিছু করতাম না)| এছাড়াও ছিল ছাত্রবন্ধু কিছু স্যারের ক্লাসে
কুইজ, মাইম (Dumb Charades), গল্প শোনা ইত্যাদি | জুনিয়র স্কুলে ইংরাজির গোপালদা চমৎকার গল্প বলতেন, আমরা একদম মন্ত্রমুগ্ধের
মতো বসে থাকতাম | ‘Riders to the
sea’ নামের একটি গল্প তিনি এত ভালো
বলেছিলেন যে সেটা আজও আমার মনে আছে | মনে আছে দীননাথদার সেই
বাংলা হাতেরলেখা ক্লাস আর তার জন্য জুনিয়র সেকশনের ‘বিপনী’ নামক দোকান থেকে গণহারে
Artex কোম্পানির ফাউন্টেন পেন কেনার কথা
|
![]() |
জুনিয়র স্কুল,আমরা এখানে ক্লাস ফাইভ থেকে সেভেন পর্যন্ত পড়েছি
জুনিয়র স্কুল, অন্য দিক থেকে
জুনিয়রের অ্যাসেম্ব্লি হল
|
![]() |
সিনিয়র স্কুল, এখানে ক্লাস এইট থেকে টেন পড়েছি
|
![]() |
সিনিয়র স্কুল,অন্য দিক থেকে
|
লাঞ্চ-ব্রেক
চার পিরিয়ডের পর
ভবনে ফিরে মহানন্দে ওয়াটার ফাইটিং | জুনিয়র সেকশনে অদ্বৈতানন্দ ও নিরঞ্জনানন্দ ভবনের পিছনের কলপাড়ে আর সিনিয়র
সেকশনে বাথরুমের সেই জলযুদ্ধের আনন্দ জীবনে ভোলবার নয় |
অজিত(সেনগুপ্ত)দা বলতেন আলু হল ভগবান, কারণ সর্বত্র সে বিরাজমান | জুনিয়রের
তপন মহারাজ জোর করে বেশি তরকারী খাওয়াতেন সবাইকে আর বলতেন, “হ্যাঁ রে, হস্টেলেও
থাকবে আর আলুও খাবেনা, তাও কি হয়??” ভবন জয়ন্তীর দিনের লাঞ্চটা হতো দূর্দান্ত,
সেদিন আমাদের ‘ওং বহ্মার্পণাং ব্রহ্মহবি..’র জন্য অপেক্ষা করতে আর তর সইত না !
![]() |
ভবন জয়ন্তীতে সাজানো হস্টেলের বারান্দা (চিত্রঋণ
– বিশ্বনাথ মহারাজ)
|
আবার মাঝেমাঝে টেস্ট চেঞ্জের জন্য পেট খারাপের মিথ্যা অজুহাতে ‘রুগীর ঝোল’ও খেয়েছি
আমরা | এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, নরেন্দ্রপুর হসপিটালের পেঁপে দিয়ে
রাঁধা মুর্গির ঝোলটা কিন্তু ছিল জাস্ট অসাধারণ, যারা খায়নি তারা ভালো একটা জিনিস
মিস করেছে | জুনিয়রের ডাইনিং হল স্টাফদের মধ্যে অদ্বৈতানন্দ ভবনের
মাখনদা ও দেবুদা, আর সিনিয়রের স্টাফদের মধ্যে যোগানন্দের অজয়দার কথা আজও মনে আছে | মাখনদাকে
নিয়ে তো ছড়াও বাঁধা হয়েছিল – “পলাশীর প্রান্তরে/ মাখনদা হাতা নাড়ে” |
স্কুল – সেকেন্ড হাফ :
লাঞ্চের পর আবার সেই ধরাচূড়ো পরে স্কুলে আসা সেকেন্ড হাফের ক্লাস করার জন্য | পেটপুরে খাওয়াদাওয়ার
পর ফ্যানের তলায় বসে ক্লাস চলাকালীন দু চোখ খুলে রাখাটাই একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ
ছিল | তারমধ্যে যেদিন দুপুরে আলুপোস্ত থাকত সেদিন
তো কথাই নেই !! শেষ পিরিয়ডটা যেন কাটতেই চাইত না | স্কুল
শেষের ঘন্টা বাজতেই দৌড়ে হস্টেল পৌঁছে ‘লাইট টিফিন’ নিয়ে সোজা খেলার মাঠে | বৃহঃস্পতিবার অবশ্য ছিল হাফ-ডে, কিন্তু সেদিনও
দুপুরে শান্তিমতো ঘুমানোর জো সিনিয়র সেকশনে ছিল না, দুপুর তিনটে বাজতেই হাজির হতে
হতো NCC বা শরদ মিরানিদার ‘বিদ্যালয় ট্রুপ’-এ প্যারেড করবার জন্য | জুনিয়র
সেকশনে এসব না থাকলেও চূড়ান্ত হাস্যকর অন্য একটি ব্যবস্থা ছিল, সেটা হল ফনীদার সেই
‘ব্রতচারী’ যেখানে আমাদের ‘ব্রতচারী হয়ে দেখ’ বা ‘ও কাইয়ে ধান খাইলো রে’ গোছের
বালখিল্য গান গাইতে হতো |
প্লে টাইম :
জুনিয়রের খেলার মাঠটা ছোট হলেও ক্যাম্পাসের মধ্যে ছিল অনেকগুলো ব্যাডমিন্টন
কোর্ট, মাঝে মাঝেই হেডমাস্টার অশোকদা বিকালে ব্যাডমিন্টন খেলতে আসতেন | অদ্বৈতানন্দ
আর অভেদানন্দ ভবনের মাঝখানে একটা ভলিবল কোর্টও ছিল | এসবের
পাশাপাশি মাঝেমাঝে ক্যারম খেলা, শিশুসুলভ আনন্দে কখনো কখনো দোলনা বা স্লিপ চড়া,
গোলঘরে বসে আড্ডা দেওয়া কিংবা হরিণকে পাতা খাওয়ানোর চেষ্টা করা | তবে সিনিয়র
সেকশনের স্টেডিয়ামের বাইরের খেলার মাঠটা ছিল মনমাতানো | সেই ডাবর
কারখানার সাইরেন আর সেখান থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত গন্ধটা – দুটোই যেন আদি অনন্ত কাল
ধরে ওই মাঠটার সঙ্গী | বৃষ্টিস্নাত রামধনুমাখা বিকালে ফুটবল খেলাটা যেন জমতো আরো
ভালো | পরীক্ষার আগের দিনগুলোয় আমরা অনেকে মাঠে আসতাম বই হাতে
নিয়ে | সেদিন খেলা কম্পালসারি নয়, ফলে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে
গুলতানি মারতে বসে যেতাম আমরা সবাই | ‘রথযাত্রা ফুটবল টুর্নামেন্ট’ ছিল আমাদের কাছে
বিশ্বকাপের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর সেখানে সবচেয়ে উত্তেজনার ‘ডার্বি ম্যাচ’
ছিল জুনিয়র সেকশনের মাঠে হওয়া সেভেন ইংলিশ মিডিয়াম বনাম সেভেন বেঙ্গলি মিডিয়ামের
ম্যাচ | অ্যানুয়াল স্পোর্টস এর দিনগুলোও ছিল ভারী আনন্দের | রিলে রেস
আর টিচার ভার্সেস স্টুডেন্ট-এর টাগ অফ ওয়ার ছিল সবথেকে জনপ্রিয় ইভেন্ট | অ্যানুয়াল
স্পোর্টসের কথা মনে পড়লেই আজও কানে বাজে প্রশান্ত গিরিদার সেই বিখ্যাত কন্ঠস্বর -
“ফোর হান্ড্রেড মিটার ফার্স্ট কল” কিংবা “লেবু ভলান্টিয়াররা এগিয়ে যাও” ইত্যাদি
ইত্যাদি | নরনারায়ণ সেবার আগের দিন আবার খেলা ক্যানসেল, প্লে-টাইমে
বসে সবাই মিলে মটরশুঁটি ছাড়িয়েছি |
মাঠ থেকে ফিরে স্নানঘর এবং সেখান থেকে বেরিয়ে ডাইনিং হলে গিয়ে ‘হেভি টিফিন’ করা | চপ-মুড়ি, মশলামুড়ি আর চিকেন চাউমিন আমাদের ভারী পছন্দের জিনিস ছিল | ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আবার প্রেয়ার হল | এইপর্বেই আমাদের নরেন্দ্রপুর নস্টালজিয়ার বহুল-চর্চিত এলিমেন্ট - “খন্ডন ভব বন্দন” সন্ধ্যারতি | আজও যদি কখনো সন্ধ্যাবেলায় টিভি রেডিও বা অন্য কোথাও থেকে এই গানটা কানে আসে তাহলে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি, মনটা আজ থেকে ১৪-১৫ বছর আগের কোনো এক সন্ধ্যাবেলায় ফিরে যায় !
ইভনিং স্টাডি আর ডিনার :
নিরঞ্জনানন্দ আর যোগানন্দ ভবনে থাকাকালীন যেদিন রাতে মাংস থাকত সেদিন সন্ধ্যার
স্টাডিহলে মন বসানোই মুশকিল হয়ে পড়ত গন্ধের চোটে | আর যেদিন
রাতে বিরিয়ানি থাকত সেদিন তো কথাই নেই ! প্যারাডাইস তো দূর অস্ত,
আরসালান-সিরাজ-আমিনিয়ার নামও আমরা তখন শুনিনি, সেই বয়সে আমরা বিরিয়ানি বলতে বুঝতাম
মিশনের ওই মোটা চালের বিরিয়ানি আর সঙ্গে মুর্গির ঝোল- কি অপূর্ব স্বাদ ছিলো তার !
সন্ধ্যের স্টাডিহলে বুক-ক্রিকেট আর বুক-ফুটবল অনেক খেলেছি | স্টাডি হল
থেকে টয়লেটের নাম করে বেরিয়ে রুমে গিয়ে হালকা করে ঘুম দিয়ে এসেছে- এরকম কেসও অনেক
রয়েছে | স্টাডি হলে বসে প্রতিদিন কানে ভেসে আসত সেই ‘আল্লাহ হু
আকবর’ আজানের ধ্বনি, পাশের কলোনী থেকে | স্কুল ম্যাগাজিন ‘ফাল্গুনী’
পাওয়ার পরের বেশ কয়েকটা স্টাডি টাইম আমরা ওর পিছনেই ব্যয় করতাম |
![]() |
বহুপুরনো এক ফাল্গুনী সংখ্যার প্রচ্ছদ |
শনিবারের সন্ধ্যেটা কিন্তু ছিল চরম ! কুইজ, মিউজিক, এক্সটেম্পোর স্পিচ, এলোকিউশন, স্টোরি টেলিং কিংবা ১৫ই অগাস্টের সেই দেশাত্ববোধক নাটকের প্রতিযোগিতা | অন্যদিকে অ্যাসেম্বলি হল কিংবা অডিটোরিয়ামে নানা সিনেমা | প্রচুর ভালো সিনেমা যেমন দেখেছি, তার পাশাপশি জুনিয়র সেকশনে ফি বছর ‘যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ’ নামক ঘুমপাড়ানি সিনেমাটি দেখবার অভিজ্ঞতাও ভুলবার নয় | অডিটোরিয়ামে চলা নানা সিনেমার ম্যানুয়াল সেন্সরিংয়ের দায়িত্বে থাকতেন রনজিৎ মহারাজ, প্রেম-ভালবাসার দৃশ্য এলেই প্রজেক্টরের সামনে নিজের ইয়াব্বড়ো হাতটা এনে ছবিটা ব্লক করতেন |
অডিটোরিয়াম (বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী হল)
|
ডিনারের পর ‘সেল্ফ স্টাডি’তে পরীক্ষার আগের দিন ছাড়া অন্য কোনদিন পড়েছি বলে মনে পড়ছে না | বরং এই সময়ে যথেচ্ছ ‘চপ্পল ক্রিকেট’ খেলেছি রুমের মধ্যে | যোগানন্দ ভবনে দু’বছর (ক্লাস নাইন আর টেন) থাকাকালীন এই সময়েই মুড়িমাখা, আমমাখা, বাতাবি লেবু মাখা ইত্যাদি খেয়েছি বহুদিন | জুনিয়র সেকশনে থাকাকালীন এই সময়টায় অনেকদিন গৌরদা, তপন মহারাজ কিংবা অন্যদের মুখে ভূতের গল্প শুনেছি | সেই বাঁশবনের, অভেদানন্দের ডাইনিং হলের সামনের পুকুরের সব ভৌতিক গল্প | বুদ্ধপূর্নিমার রাতে ভয়ের চোটে রুমের সবাই একসাথে খাট জোড়া লাগিয়ে শুয়েছি | সিনিয়র সেকশনে এক্সিবিশনের আগে রাত জেগে চার্ট, মডেলও বানিয়েছি প্রচুর | অন্যদিকে পরীক্ষার আগের রাতে লাইট অফের পর লুকিয়ে লুকিয়ে বিছানায় টর্চ জ্বালিয়ে বা বাথরুমের মধ্যে উল্টানো বালতির উপর বসে পড়াও করেছি |
![]() |
Exhibition-এর প্রস্তুতি |
এইরকমই অসংখ্য স্মৃতি আমাদের আবাসিক জীবনের | নরেন্দ্রপুরের দুর্গোৎসব ‘অ্যানুয়াল এক্সিবিশন’-এর চারদিন ছিল
সবচেয়ে স্পেশাল | এছাড়াও রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমবাগানের
অনুষ্ঠান, নরনারায়ণ সেবার দিন খাবার পরিবেশন করা, রামকৃষ্ণ জন্ম জয়ন্তীর প্রসেশন,
স্কুল ট্যুর, অ্যানুয়াল স্পোর্টসের দু’দিন, ১৫ই আগস্ট আর ২৬শে জানুয়ারীর
মার্চপাস্ট –
প্রত্যেকটির মজা ছিল আলাদা আলাদা | রবিবারের সকাল কাটত মাঠে গিয়ে
ক্রিকেট খেলে আর টিভিতে Captain Vyom, শক্তিমান, বিরাট
ইত্যাদি সিরিয়াল দেখে | ঝড়জলের রাতের পরেরদিন সকালে
আমকুড়ানোর মজাই ছিল আলাদা | বসন্তকালের বিকালে
কিরকম মনখারাপ করা ব্যাপার লুকিয়ে থাকত যে সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা থাকা সত্বেও
পড়ায় মন বসত না | এছাড়াও ছিল খোলা প্রান্তরে বসে
এম.কে.দাস মেমোরিয়াল ড্রয়িং কম্পিটিশনে ছবি আঁকা | ছিল জুনিয়র সেকশনে ‘স্টক সিজ’ হওয়ার ভয়ে বাথরুমে বালতির
মধ্যে কাপড়চাপা দিয়ে চিপসের প্যাকেট লুকিয়ে রাখা অথবা ‘বেস্ট সিনিয়র-বেস্ট জুনিয়র’
নিয়ে বন্ধুদের খ্যাপানো | শরীর খারাপ হলে বাহাদুরদার
রিক্সায় চড়ে হসপিটাল যাওয়া আর সেখানে ডঃ বিদ্যুত দত্ত রায়ের গলা ব্যথার জন্য ক্রেপ-ব্যান্ডেজ
প্রেসক্রাইব করা | একটু বড় হওয়ার পর ‘ভিসিটিং ডে’তে
আর এক্সিবিশনে বন্ধুদের সুন্দরী বোনদের ঝাড়ি মারা ! স্যারেদের মিমিক্রি করে গান
বাঁধা | রেইনি ডে তে হস্টেলের বারান্দায়
জলের মধ্যে ডাইভ দেওয়া | এইসব অভিজ্ঞতার তালিকা লিখে শেষ
করা যাবে না !
![]() |
২০০১ সালে ক্লাস নাইনে বার্ষিক
প্রদর্শনীতে আমাদের প্রজেক্ট ‘Medical Detective’
|
![]() |
২০০০ সালের ২৬ শে জানুয়ারীর প্যারেডের
গ্রুপ-ফটো
|
![]() |
অভেদানন্দ ভবন জয়ন্তী, ১৯৯৭ সাল, আমি (প্রথম সারি, বাঁ-দিক থেকে তৃতীয়) তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি
|
জুনিয়র সেকশনে থাকতে শরীর খারাপ হলে বাহাদুরদার রিক্সায় চড়েই আমরা
হাসপাতাল যেতাম
|
পুনশ্চঃ
১৯৯৬ সালের ২৪শে এপ্রিল | বাবা-মার হাত ধরে বাক্স-প্যাঁটরা সমেত ‘ছোট্ট
আমি’ হাজির হয়েছিলাম অদ্বৈতানন্দ ভবনের
একতলায় উত্তম মহারাজের (স্বামী ত্যাগীবরানন্দ)ঠিক পাশের রুমটায় | তারপর ১৯
বছর কেটে গেছে, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, নরেন্দ্রপুরও অনেক বদলেছে, শুধু
বদলায়নি স্কুলের সেই স্মৃতিগুলো | নরেন্দ্রপুর নিয়ে আমার এই স্মৃতিকথাগুলো লেখার মূল উদ্দেশ্যই হল পাঠককে তাঁর
নিজের স্মৃতির সরণী বেয়ে পৌঁছে দেওয়া তাঁর ফেলে আসা সেই সোনালী দিনগুলোয় |
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন তো নিছক স্কুলমাত্র নয়, এ হল ‘A sweet home away from home’ | বহুদিন প্রবাসে থাকবার পর নিজের বাড়িতে ফিরতে কারই না ভালো লাগে ! হোক না সেই
ঘরে ফেরা সামান্য কিছু মুহুর্তের জন্য, সশরীরে না হয়ে শুধুমাত্র মানসচক্ষে ! সেই
বা কম কিসের ?
মিশনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হস্টেল-লাইফের সাম্প্রতিকতম
ডেইলি শিডিউলটা লেখাটার সঙ্গে দিলাম |
![]() |
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের হস্টেল-লাইফের ডেইলি শিডিউল
|
_________________________________________________
© অর্ঘ্য দাস (মাধ্যমিক ২০০২, উঃ মাঃ ২০০৪)
দুর্গানগর, ১-৫-২০১৫
Osadharon smriti romonthon..
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ !!
Deletedurdanto. ar eta tomar kachhei expected.
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ !!
Deletesotti osadharon arghya da... :-)
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ !!
Delete