Skip to main content

জনমেজয়-বৈশ্যম্পায়ন সংবাদ : পর্ব ১: ভারতীয় ক্রিকেট ফ্যান



জনমেজয় কহিলেন, “ হে মহর্ষে ! আপনি কহিলেন যে কলিযুগে ‘ক্রিকেট ফ্যান’ নামক এক প্রকার জীব ভারতবর্ষে আবির্ভূত হইবেন | তাহারা কি প্রকার জীব হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতুহল জন্মিতেছে | আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন |”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, “হে নরবর ! আমি সেই বিচিত্রবুদ্ধি, হুজুগে এবং দোষারোপপ্রিয় ভারতীয় ‘ক্রিকেট ফ্যান’গনকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন | হে রাজন, যাহারা বৎসরে মাত্র পনের দিন নীল জার্সি পরিধান করিয়া, মুখমন্ডল ত্রিবর্ণে রঞ্জিত করিয়া এবং হস্তে জাতীয় পতাকা ধারণ করিয়া নিজদিগকে শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক মনে করিবেন তাহারাই ক্রিকেট ফ্যান |  যিনি ক্রিকেটের কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কম্পিউটার গেম ‘ই এ স্পোর্টস’ খেলিয়া নিজেকে ক্রিকেটের দিকগজ মনে করিবেন এবং একটিমাত্র ম্যাচ হারিবার জন্য দেশজ ক্রিকেটারদের অকথ্য ভাষায় গালিমন্দ করিয়া উহাদের পূর্বপুরুষ উদ্ধার করিবেন ও ক্রিকেটারদের বাসস্হান ভাঙ্গনে উদ্যোগী হবেন তিনিই ক্রিকেট ফ্যান | যিনি দেশের একটি ম্যাচ জয়ের পরে ক্রিকেটারের চিত্রে মাল্যদান করিয়া আনন্দের আতিসজ্যে জাম্বুমানের ন্যায় লম্ফঝম্ফ করিবেন এবং পরবর্তী ম্যাচে হারের পর ওই একই চিত্রে পাদুকার মাল্য চড়াইয়া উহাতে অগ্নিসংযোগ করিবেন তিনিই ক্রিকেট ফ্যান | যিনি নিজে একাধিক রমনীর সাথে রস করিবার ইচ্ছা রাখিবেন, কিন্তু দেশের কোনো ক্রিকেটারের সুন্দরী বান্ধবী থাকিলে মারাত্মক গাত্রদাহে জর্জরিত হইবেন, এবং ওই বান্ধবীকেই ওই ক্রিকেটারের আন্ডারপারফরম্যান্সের জন্য দোষী সাব্যস্ত করিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগের তুফান তুলিবেন তিনিই ক্রিকেট ফ্যান |

হে নরশ্রেষ্ঠ ! যিনি টিভির সম্মুখে বসিয়া ক্রিকেট অধিনায়ককে ফিল্ড চেঞ্জের জন্য জ্ঞান দিবেন, এক একটি উইকেট পতনের পর ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট দিবেন, দেশের পরাজয়ের পর বাসে-ট্রেনে-চায়ের দোকানে তর্কের ঝড় তুলিবেন এবং নিজেকে নেভিল কার্ডাস মনে করিয়া ট্যুইটারে লম্বা নিবন্ধ লিখিবেন তিনিই ক্রিকেট ফ্যান | ইঁহারা জগতের বাকি সমস্ত কার্য স্থগিত করিয়া, স্ত্রী-পুত্র বন্ধক রাখিয়া, নিজ জীবন বাজি রাখিয়া খেলা দেখিবেন এবং ইঁহাদের জীবন-মরণ ক্রিকেট খেলার ফলাফলের উপর নির্ভর করিবে |

হে মহারাজ ! যাহারা বাক্যে ব্র্যাডম্যান, ক্রিকেটারদের বাড়ির সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শনে স্টোনম্যান, জিতিবার উল্লাসে লম্ফঝম্ফে হনুমান, হারিবার দুঃখে মুহ্যমান, গালিগালাজে বেইমান এবং নিজেরা ব্যাট হস্তে ধারণ করিলে তাহা ক্রিকেট নামক খেলাটির অপমান তাঁহারাই ক্রিকেট ফ্যান | ইঁহারা দুর্বল টিমের বিরুদ্ধে নিজ দেশের ফ্যান-টাসটিক পারফর্মেন্সের পর ঘি সহযোগে ফ্যান-ভাত ভক্ষণ করিয়া সিলিং ফ্যানের বাতাসে তোফা নিদ্রা যাইবেন এবং ফ্যান-টাসির জগতে বিচরণ করিয়া এক ফুৎকারেই বিশ্বসেরা টিমকে উড়াইয়া দিবার অযৌক্তিক স্বপ্ন দর্শন করিবেন | পরবর্তীকালে এই স্বপ্ন পূরণ না হইলে ইঁহারা দুই দিবসকাল টিম সিলেক্টর, খেলোয়াড় এবং খেলোয়াড়পত্নীদের মুন্ডপাত করিবেন এবং অতঃপর এইসব ভুলিয়া আই পি এল, লা লিগা এবং বিবিধ প্রকার কম্পিউটার গেমে মনোনিবেশ করিবেন |

জনমেজয় কহিলেন, “হে মুনিপুঙ্গব ! আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন |

©অর্ঘ্য দাস
২৭-০৩-২০১৫


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...