বহু বছর পেরিয়ে আসার পরও প্রাক্তনী বন্ধুদের আলোচনায় নরেন্দ্রপুর
রামকৃষ্ণ মিশন বারেবারে ফিরে আসে | আসলে ওটা তো আমাদের কাছে নিছক 'স্কুল' ছিল না, বছরের নয় মাস আমরা সেখানে থাকতাম, ফলে নিজের বাড়ি হয়ে যেত 'সেকেন্ড হোম' আর স্কুল হয়ে উঠত 'বাড়ি' | পুরনো বন্ধুদের সেই স্মৃতিচারণায় নানা মজাদার ঘটনার পাশাপাশি উঠে আসে কিছু মানুষের নাম - যাঁরা আমাদের বড় করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন | এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ঊদ্ধৃতি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক -
“অতএব যাদের
উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া, তাদের কোনমতেই উচিত
হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া | ছাত্রদের ভার তাঁরাই লইবার অধিকারী,
যাঁরা নিজের চেয়ে বয়সে অল্প, জ্ঞানে অপ্রবীণ ও ক্ষমতায় দুর্বলকেও সহজেই শ্রদ্ধা
করিতে পারেন, যাঁরা জানেন শক্তস্য ভূষনং ক্ষমা, যাঁরা ছাত্রকেও মিত্র বলিয়া গ্রহণ
করিতে কুন্ঠিত হন না |” (ছাত্রশাসনতন্ত্র, শিক্ষা, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৬)
উপরের শর্তানুযায়ী বলতে পারি আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অন্ততঃ শতকরা নব্বই জন
সত্যি সত্যিই ছাত্রদের ভার নেবার অধিকারী ছিলেন | নরেন্দ্রপুরের
একটি অতি প্রাচীন প্রথা হল মাস্টারমশাইকে ‘দাদা’ বলে ডাকা, কারণ এতে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে আত্মিক সম্বন্ধ স্থাপিত হয় | আমাদের
এই অতি প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বায়োলজির অজিতদা, ইংরাজির
নিখিলদা, বাংলার বেনুদা-সন্তোষ মুখার্জিদা, অঙ্কের শংকরদা, ইতিহাসের শচীনদা, কেমিস্ট্রির গৌরহরি ঘোষবাগদা, ফিজিক্সের নারায়নদা –
কাকে ছেড়ে কার নাম করব !!
আজ এই লেখা নিখিলদা কে নিয়ে | প্রয়াত শ্রী নিখিল চরণ বসু
(১৯১৭ – ২০১১) উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের
প্রধান শিক্ষকের পদ হতে অবসর নেন ১৯৭৫ সালে | এরপর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের
কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি নরেন্দ্রপুরে
শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং ২০০৯ সাল অব্দি শিক্ষকতা করেন | নরেন্দ্রপুরের
এটি একটি পুরনো প্রথা, শিক্ষকতা যাঁদের কাছে শুধুমাত্র পেশা নয়, নেশা এবং প্যাশন-ও
বটে, শুধুমাত্র বয়সের সীমাতে আবদ্ধ হয়ে যাঁরা দেশের ভবিষ্যত গঠনের কাজে ইতি দিতে
চান না, এমন অনেক মানুষই সরকারী ভাবে অবসর গ্রহনের পরেও নরেন্দ্রপুরে শিক্ষকতা
চালিয়ে যান | নিখিলদা ৯২ বছর বয়সেও নিয়মিত স্কুলে এসে ক্লাস নিয়েছেন – এই
একটিমাত্র তথ্যই মানুষটির নিষ্ঠা এবং দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয় | অসামান্য পান্ডিত্যের পাশাপাশি তাঁর সৌজন্যবোধও ছিল অতুলনীয় | নিখিলদার জীবনের দুটি ঘটনা এখানে লিখবো, দুটির প্রতিটিই আমরা নানা আলাদা জায়গা থেকে শুনেছি, ফলে এগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই |
২০০০ সাল নাগাদ একবার নিখিলদা অসুস্থ হয়ে পড়েন | বার দুয়েক
হার্ট অ্যাটাকও হয় | তখন সাময়িকভাবে নিখিলদা ভেবেছিলেন যে শিক্ষকতার পর্বে
পাকাপাকি ভাবে ইতি টানবেন | কিন্তু পরে উনি সিদ্ধান্ত নেন যে উনি স্কুলে ক্লাস
নিতে আসবেন, কারণ তিনি ভেবেছিলেন যে অসুস্থ শরীরে শিক্ষকতা করাকালীন ক্লাসের
মধ্যেই যদি ভালোমন্দ কিছু হয়েও যায় তাহলেও ব্যাপারটা মোটেও খারাপ কিছু হবেনা,
বরঞ্চ খানিকটা 'পোয়েটিক জাস্টিস' হয়েই থাকবে | সত্যিই, যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া আর কোথায়ই
বা বীরের মৃত্যু বেশি গৌরবজনক হয় !!
দ্বিতীয় ঘটনাটি এরকম – নরেন্দ্রপুরে দীর্ঘ ৩৪ বছরের
শিক্ষকতার জীবনে নিখিলদা নাকি একবারই আগে থেকে না জানিয়ে ‘লেট’ করে স্কুলে
এসেছিলেন | সেদিন ওনাকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল | ফার্স্ট হাফে দুটো ক্লাস নিয়ে
উনি হেডমাস্টারের ঘরে গিয়ে অনুরোধ করেন যদি তাকে সেদিনকার মতো সেকেন্ড হাফের
ক্লাসগুলো থেকে দায়িত্বমুক্ত করা যায় | সিনিয়রমোস্ট টিচার, সকলের পরম শ্রদ্ধেয়
নিখিলদার এই অনুরোধে হেডমাস্টার মহারাজ বিনা প্রশ্নে তক্ষুনি রাজি হয়ে যান | উত্তর
শুনেও নিখিলদা খানিক ইতস্ততঃ করছেন দেখে মহারাজ জিজ্ঞাসা করেন কি হয়েছে | উত্তরে
নিখিলদা বলেন, ৪০ বছর যার সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন সেই মানুষটি (ওনার স্ত্রী) গতকাল
রাত্রে মারা গেছেন, আজ সকালে সেজন্যই নিখিলদার স্কুলে আসতে দেরী হয়েছে | স্কুলের
যদি অসুবিধা না হয় তাহলে উনি এখন বাড়ি যাবেন, বাকি ক্রিয়াকর্ম সম্পাদিত করার জন্য
|
সবথেকে মজার ব্যাপার হল এইসব অতিমানবীয় ঘটনা সত্ত্বেও
নিখিলদাকে ছাত্রদের কখনই দুরের নক্ষত্রের বাসিন্দা বলে মনে হয়নি | কারণ তিনি হাঁটুর বয়সী ছাত্রকে বরাবর সম্মান দেখিয়ে এসেছেন, তাদের আপন করে নিয়েছেন, ছাত্রদের ভুলে
বিরক্ত না হয়ে ভুল শুধরাতে তাদের সাহায্য করেছেন | ক্লাস টেনের টেস্টের পর দীর্ঘ
সময় নিয়ে তাদের ‘প্রাকটিস পেপার’ চেক করেছেন | নিজের শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত
দেখিয়ে কোনো কাজকে এড়িয়ে যাননি | স্কুলের করিডরে যখনই কোনো ছাত্রের সাথে দেখা
হয়েছে সহাস্যে প্রতিসম্ভাষণ জানিয়েছেন | নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন
তার জন্মলগ্ন হতে আজ পর্যন্ত বহু অসামান্য শিক্ষককে প্রত্যক্ষ করেছে, প্রয়াত নিখিল
চরণ বসু নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা |
পুনশ্চ: আমাদের বন্ধু প্রণব একটি অসামান্য আর্টিকেল লিখেছিল
নিখিলদাকে নিয়ে, লিঙ্কটা নিচে দিলাম | আমি প্রত্যেক পাঠককে অনরোধ করছি এই লেখাটি
একবার পড়ে দেখার জন্য |
© অর্ঘ্য দাস, মাধ্যমিক 2002, উঃ মাঃ 2004
(দুর্গানগর, ২৫-০৩-২০১৫)
![]() |
পরম শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শ্রী নিখিল চরণ বসু |
Comments
Post a Comment