Skip to main content

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৬ : কাঁড়ি দিবস


আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি, ২০০১ সাল, একদিন কেমিস্ট্রি ক্লাসে গৌরহরি ঘোষবাগদা কথায় কথায় বলে ফেললেন যে কয়েক বছর আগে সিনিয়র সেকশনের হস্টেলগুলোয় ছেলেরা ডিনারে কাঁড়ি দিবস পালন করেছিল | কনসেপ্টটা আমাদের কাছে নতুন ছিল, স্যারকে জিজ্ঞাসা করলে উনি বললেন ‘কাঁড়ি দিবস’-এর অর্থ হল ‘কাঁড়ি কাঁড়ি খাওয়া’, মানে এতটাই বেশি খাওয়া যে খাবার কম পড়ে যাবে, ফলে ডাইনিং হল ও মেইন কিচেনে হুলস্থুল পড়ে যাবে এবং তারা বাধ্য হবে আবার রান্না বসাতে | 

গৌরহরি দা-র সাথে আমরা ক্লাস 10 E-এর ছাত্ররা (২০০১ সাল ) 

পাঠকদের জানিয়ে রাখি, নরেন্দ্রপুরের সিনিয়র সেকশনে ছয়টি হস্টেল (ভবন), এদের সবার রান্না একসাথে হয় মেইন কিচেনে, তারপর সেখান থেকে ঠেলা গাড়িতে করে খাবার হস্টেলের ডাইনিং হলগুলোতে পাঠানো হয় | খুব স্বাভাবিকভাবেই এই রান্নাবান্নার পর্ব খাওয়া শুরুর অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়, ফলে কোনদিন যদি এতো বেশি খাওয়া যায় যে অনেক লোকের খাওয়া বাকি থাকতেই সব খাবার শেষ হয়ে যাবে, তাহলে নিঃসন্দেহে কিচেন-স্টাফ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভবনের স্যার, মহারাজ সবাই বিচলিত হয়ে পড়বেন এবং তারপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আবার রান্নাবান্নার কাজ শুরু হবে | এই কাঁড়ি দিবস পালনের উদ্দেশ্য তিনটি –(১) প্রধান উদ্দ্যেশ্য নেহাতই আনন্দলাভ | ছেলেবেলায় অন্যকে অনর্থক জ্বালাতন করে সুখ পায়নি এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না | (২) মিশনের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রায় খানিক বৈচিত্র, উত্তেজনার আমদানি (৩) অথরিটিকে বিব্রত করা এবং হোস্টেলের টাইম শিডিউল খানিক বিগড়ে দেওয়া | শোষিত শ্রেনীর কিঞ্চি ক্ষমতাপ্রদর্শন !

ভাগ্যচক্রে সেদিন ছিল শনিবার, ঐদিন সিনিয়র সেকশনে ডিনারে মাংস পরিবেশন করা হতো | আমি আর আমার বন্ধু সব্যসাচী ভেবে দেখলাম এটাই মোক্ষম সুযোগ, ফলে স্কুল শেষে খেলার মাঠে গিয়ে আমরা কাঁড়ি দিবস পালনের ডাক দিয়ে ফেললাম (তখন ১১-১২ ক্লাস নরেন্দ্রপুর কলেজের অন্তর্ভুক্ত ছিল, ফলে আমরাই ছিলাম স্কুলের সিনিয়রমোস্ট ক্লাস) | প্রতিটা হস্টেলের বন্ধুদের পুরো ব্যাপারটা খোলসা করে জানানো হলো এবং তাদের নিজেদের হস্টেলে কাঁড়ি দিবস সুষ্ঠু ভাবে পালনের দায়িত্ব দেওয়া হল | ব্যাপারটা কোনোভাবেই যাতে কোনো স্টাফের কাছে আগে থেকে ‘লিক’ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখার কথা বলা হল |

খেলার মাঠ থেকে হস্টেলে ফিরে কিছু বাছাই করা ছেলেপুলেকে নিয়ে একদফা গোপন মন্ত্রণাসভা ডাকা হল | ঠিক করা হলো সেদিন রাতে প্রত্যেকে তার নর্মাল ডায়েটের অন্ততঃ তিনগুন করে খাবে | খিদে বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ পরামর্শ দিল খাবার আগে হালকা শরীরচর্চা করার | কেউ কেউ পরামর্শ দিল খেতে যাওয়ার আগে একবার ল্যাট্রিন থেকে ঘুরে আসবার জন্য | মাংসের ঝোল আর তরকারী বেশি পাওয়া না গেলে ডাল-ভাতের উপরেই কনসেন্ট্রেট করার ব্যাকআপ প্ল্যানও রাখা হল |

এরপর ডাইনিং হলে গিয়ে আমরা যেটা করেছিলাম সেটাকে ‘খাওয়া’ না বলে ‘গোগ্রাসে গেলা’ বললেই ঠিক হয় | যে ছেলে প্রতিদিন দু হাতা ভাত খায় সে প্রথমেই পাঁচ হাতা ভাত নিয়ে ফেলল | যে অন্যদিন একহাতা ডাল নেয় সে নিল চার হাতা ডাল | যে জীবনেও আলু খায় না সে খেল তিন হাতা আলুর তরকারী | লিকলিকে রোগা পাতলা ছেলেগুলো পর্যন্ত এমন খাওয়া শুরু করল যে পুরনো একটা প্রবাদ মনে পড়ে গেল- “সরু পেটে গরু ধরে” | খাওয়া শুরুর মিনিট দশেক পর ভবনের মহারাজ, স্যার আর ডাইনিং হল স্টাফরা বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল আছে | কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, ওই সময়ের মধ্যেই ডাল, তরকারী আর মাংসের ঝোল শেষ হয়ে গেছে, অন্যদিকে তখনও পরিবেশনকারী ছাত্ররা এবং স্যার, মহারাজ খেতে বসতে বাকি | মহারাজ খবর নিয়ে জানলেন যে বাকি হস্টেল গুলোতেও একই অবস্থা | ফলে আবার রান্না বসানোর নির্দেশ দেওয়া হলো | এরই মধ্যে দেখি আমাদের এক অত্যুসাহী বন্ধু মাংসের ঝোল, তরকারী, ডাল কিছুই না পেয়ে অবশেষে খালি নুন দিয়ে তার নেওয়া দশ নম্বর হাতার ভাতটা খাছে | যাইহোক, সেদিন সকলের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকাতে পাক্কা এক ঘন্টা সময় বেশি লেগেছিল |

বলা বাহুল্য আমাদের এই উদ্যোগ সফল হয়েছিল | পরের দিন অবশ্য আমাদের হস্টেলের মহারাজ (যোগানন্দ ভবনের নারায়ণ মহারাজ) অনেক ময়না তদন্ত করার চেষ্টা করেছিলেন এর পিছনে কারা ছিল তা জানবার জন্য, কিন্তু তা সফল হয়নি | বাইরের পাঠকের কাছে এই ঘটনা নিতান্তই তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে এই ঘটনাটা যথেষ্ট আলোড়ন ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল | আজও কোথাও কাউকে রাক্ষুসে খাওয়া খেতে দেখলে আমার সর্বাগ্রে এই কাঁড়ি দিবসের কথাই মনে পড়ে |


যোগানন্দ  ভবন ও নারায়ন মহারাজ 
________________________________________________
© অর্ঘ্য দাস, ৩১-০৩-২০১৫




Comments

  1. Ei Kari diboser probortok amader 95 batch. Er sathe chhilo ar ek kukhyato andolon jar naam thala andolan. Bhable ekhono Gaye kata dey.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরিব্বাস !! দাদা, এই 'থালা আন্দোলন' কী জিনিস একটু বলো |

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...
  ঝাড়গ্রাম : বসন্ত ১৪২৭ স্কুল পাশ করেছি সতেরো বছর হয়ে গেল | তারপর এই প্রথম আমার সুযোগ হলো স্কুলের বন্ধুদের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার | দু তিনটে জায়গা মাথায় ছিল – ঘাটশিলা , ঝাড়গ্রাম, অযোধ্যা পাহাড় | এই বসন্তের শুরুতে তিনটে জায়গাই মনোরম | শেষমেষ ঝাড়গ্রাম WBFDC এর গেস্ট হাউসের ছবি দেখে সেটাই ফাইনাল করা হলো | 6 ই মার্চ, 2021, শনিবার          ডিমসেদ্ধ : সকাল সাড়ে দশটা - ক্যালেন্ডারে মার্চের শুরু হলেও বেজায় গরম. আমি দরদর করে ঘামছি ডেবরা চৌমাথায় (পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) দাঁড়িয়ে, হাতে আমার একুশটা হাঁসের ডিম সেদ্ধ, সাথে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি এবং সাদা ও কালো নুন | এক সপ্তাহ আগে করা প্ল্যান অনুযায়ী আমরা নাকি আগামী দু’ ঘন্টায় গাড়িতে বসে পার হেড পাঁচটা করে হাঁসের ডিম খাবো | ওদিকে সৌমাভ ওর গাড়িতে গোল (সুমিত্র) আর পকাই (অর্ক) কে নিয়ে আসছে কলকাতা থেকে |          বব মার্লে : শেষমেষ আমায় প্রায় ঘন্টা খানেক রোদে দাঁড় করানোর পর তাঁরা এলেন এবং বসন্তের এই অকাল দাবদাহ থেকে আমায় মুক্তি দিলেন | ঠান্ডা গাড়িতে উঠে ওদের আনা এগ স্যান্ডউইচ আর কোলাঘাট KFC থেকে কেনা মুর...