Skip to main content

ফেসবুক আপডেট: পর্ব ১

ফেসবুক আপডেট  

সেদিন একটা মজাদার ফটো দেখলাম | প্রস্তর যুগের দুই শিকারী এক বিশালকায় বাইসন মেরে ফিরেছে | এক শিকারীর তো আর তর সইছে না, তার দাবী হলো তখুনি খাওয়াদাওয়া শুরু করা হোক, অন্যদিকে আরেক শিকারী গুহার দেওয়ালের উপর কিসব আঁকিবুঁকি কেটে চলেছে পাথর দিয়ে | প্রথম শিকারী কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলে দ্বিতীয় শিকারী জানায় যে সে শিকারপর্বের সচিত্র-আপডেট দিচ্ছে গুহার ওয়াল-এ |

ইতিহাসের নিয়ম মেনেই মানুষ আজও সেই আপডেট দিয়ে চলেছে | মার্ক জুকেরবার্গ পাথরের দেওয়াল খোদাইয়ের পরিশ্রম কমিয়েছেন ফেসবুকের জন্ম দিয়ে | স্মার্টফোন নামক যন্ত্রটি ‘সেলফি’ নামক যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছে | মধ্যবিত্তের আশা আকাঙ্খার তালিকায় একটি নতুন জিনিস যোগ হয়েছে – ফেসবুকে ‘লাইক’ পাওয়া | চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির যুগেও বাজারে মিলছে নানা রকম সস্তা ইন্টারনেট-প্যাক | এই সুযোগে মেয়েরা মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে আরো সুন্দরী হয়ে উঠে এবং ছেলেরা  সিক্স-প্যাক বানিয়ে আরো মাচো হয়ে উঠে নিজেদের সেলফি তুলে পটাপট আপডেট দিচ্ছে ফেসবুকে |

আজকাল আর রাস্তায় দু’দন্ড দাঁড়িয়ে লোকের সাথে দু-চারটে কথা বলার সুযোগ এবং সময় যখন হচ্ছে না, তখন বিভিন্ন সোশাল মিডিয়াতেই যে মানুষ ‘সোশালাইজ’ করবেন এ নিয়ে আশ্চর্যের কিছু নেই | জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট, যেমন – নিজের বিয়ে, বাপের বিয়ে, Bi son (যমজ ছেলে)-এর জন্ম দেওয়া, শিকারে যাওয়া (জঙ্গল সাফারি), নতুন চাকরি, পরীক্ষায় ভালো ফল ইত্যাদির সচিত্র আপডেট অবশ্যই স্বাগত | কিন্তু কিছু মানুষের কাজই হলো ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাত্রে ঘুমাতে যাওয়া অব্দি প্রায় প্রতিটি ধাপেই অকারণ আপডেট দেওয়া | নিজে কি করছি, কি সিনেমা দেখছি, কি গল্পের বই পড়ছি, কি রান্না করছি, কি খাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, কার সাথে রয়েছি  – সমস্ত হাঁড়ির খবরই বিশ্বসংসারকে জানানোর প্রবল তাগিদ | সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো নিজে কি ভাবছি সেটাও লোককে জানাতে হবে | রয়েছে ‘ফিলিং হ্যাপি’, ‘ফিলিং রিলাক্সড’, ‘ফিলিং ডিপ্রেসড’, ‘ফিলিং অ্যাংরি’ ইত্যাদি নানারকম কেত্তন | একমাত্র ব্রহ্মা যে গোপন কম্মটি জানেন সেটির আপডেট এখনো এদেশে কেউ দেয়নি, যদিও হোকচুম্বন আন্দোলন পার্ট টু হলে সেটাও হয়ত হয়ে যাবে |

প্রেমিক পাবলিকলি পোস্ট শেয়ার করে নিজের প্রেমিকাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে তার মতো এরকম ‘বিচ্ছিরি লোক’-এর সাথে এতদিন কাটানোর জন্য ! শুক-সারি পাবলিকলি একে অন্যের ওয়ালে পোস্ট করে ঝগড়া করছে  | একজন আরেকজনকে আবেগপূর্ণ ভাষায় ‘সরি’ বলছে, ভালো কথা, কিন্তু সেটা তো প্রানাধিককেকে মেসেজ করে বললেই হয়, নিজের প্রোফাইলে স্টেটাস আপডেট দিয়ে চোদ্দজনকে জানানোর কি মানে হয় !! এটা অনেকটা এরকম হলো – একদিন সকালে আপনি পাড়ার মোড়ের ল্যাম্পপোস্টে মাইক লাগালেন এবং তারপর ঘরে ফিরে মাউথপিসটা মুখের কাছে নিয়ে বউয়ের সাথে রসালাপ করছেন বা আপনার বাড়িতে চলতে থাকা শাশুড়ি-বৌমার কোন্দলের ধারাভাষ্য করছেন |

আরো মজাদার হচ্ছে তিন-চার শব্দের আপডেট | একটি মেয়ে ধরুন লিখল “ভালো লাগছে না”, বা “শুধু আমার সাথেই এরকম কেন হয় !”, কিংবা “কি করব বুঝতে পারছিনা” | মিনিট দশেকের মধ্যেই হ্যাংলা হা-ভাতে ছেলের দল জুটে যাবে যারা নানা ভাবে জিজ্ঞাসা করবে যে কি হয়েছে, মেয়েটিও অবশ্য সেটিই চায় | মেয়েটি খানিক ইনিয়ে বিনিয়ে তারপর আসল কারণ জানাবে, তখন অন্য দিক থেকে শুরু হবে নানা সাজেশন দেওয়ার পালা | সত্য সেলকাস !!!!

ছবি দিয়ে শুরু করেছিলাম, ছবি দিয়েই শেষ করি | সম্প্রতি আরেকটি মজাদার ফটোতে দেখলাম, কবরের মধ্যে শুয়ে মৃত মানুষের আত্মা আফসোস করছে, শেষ স্টেটাস টা আপডেট করা হলনা বলে !!

পাঠককূলের মনোরঞ্জনের জন্য ইন্টারনেট থেকে পাওয়া কয়েকটা প্রাসঙ্গিক ছবি লেখাটার সাথে অ্যাটাচ করলাম |
__________ 

©অর্ঘ্য দাস 





Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...