*******************************************************
দুর্গানগর, রোববার দুপুর ৩ টে, ১৫ই
মার্চ ২০১৫ | ক্যালেন্ডারে বসন্ত কাল হলেও বেজায় গরম পড়েছে |
ঘরে ঘরে বাঙালী দুপুরে ভালোমন্দ খেয়ে ঘুম দিচ্ছে | দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে, খুলবে আবার সন্ধ্যার পর |
উস্কখুস্ক চুলে এক পথিকের আগমন | রাস্তার পাশেই একটা
নীল-সাদা বাড়ি, তার ব্যালকনিতে বসে বছর ২৭-২৮ এর এক যুবক
ফোনে কার সাথে কথা বলছে |
পথিক: দাদা, কোথায় এখানে একটু সিগারেট পাই বলতে পারবেন ?
যুবক : ‘সিগারেট-পাই’ ? তা তো জানি না | তবে এবাড়িতে এক
‘কিউটি-পাই’ আছে | এখন সেজেগুজে সেলফি তুলছে, ফেসবুকে আপলোড করবে বলে | ডেকে দেব?
পথিক: আরে না না দাদা, আমেরিকান পাই, পাই কেক , জলপাই, অঙ্কের পাই, পাইথন -
এসব কোনকিছুর কথা বলছি না | আসলে বলছি সেই কখন
বেরিয়েছি বাড়ি থেকে, রোদের মধ্যে ঘুরে মাথা বনবন করছে,
একটু ধুম্রপান করতে পারলে বাঁচতাম | তাই
জিজ্ঞাসা করছিলাম কাছাকাছি কোনো পান-বিড়ির দোকান আছে নাকি !
যুবক: বাড়ি কোথায় আপনার?
পথিক: বারাসাত |
যুবক : সেই সুদুর বারাসাত থেকে সিগারেট আর পানের খোঁজ
করতে দুর্গানগর এসেছেন ! তাজ্জব ব্যাপার ! আপনি তো মশাই এখানে না এসে পানাহাটি
কিংবা সোজা জাপানেই চলে যেতে পারতেন, নয়তো পানাপুকুরে ডুবে সোজা উর্দ্ধপানে ! শুধুমাত্র পাঞ্জাবে গেলেই আপনার
চাপ, সর্দারগুলো আলবাল সব খায়, কিন্তু
বিড়ি-সিগারেটের নাম শুনলে কৃপাণ হাতে তেড়ে আসে |
পথিক (খানিক বিরক্ত হয়ে): আরে
মশাই, আমি বারাসাতের এক কুরিয়র
কোম্পানির অফিস থেকে আসছি | অনেকগুলো ডেলিভারি ছিল এই অঞ্চলে,
এতক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে মালগুলো খালাস করলাম | এখন
এই ভরদুপুরে রাস্তায় একটা লোকও দেখছি না, তাই আপনাকে
জিজ্ঞাসা করলাম |
যুবক (বেশ রাগত স্বরে): তা ভাই
দেখতেই পাচ্ছেন রাস্তাঘাট সুনসান, কোত্থাও
কেউ নেই | তাহলে খামোখা আমায় বিরক্ত করে আবোলতাবোল জিজ্ঞাসা
করছেন কেন ? ভাগুন এখান থেকে ! মাওবাদী কোথাকার !!!
পথিক খানিক অবাক হয়েই নীল-সাদা রঙের বাড়িটার দিকে চেয়ে রইলো
! মনে মনে ভাবলো কি সব আজব লোকজনের বাস এই বঙ্গে !
********************************************************
রাস্তার দিকে মুখ ফিরাতেই পথিক দেখলো লাল গামছা কাঁধে এক
মাঝবয়সী লোক এদিকেই আসছে | লোকটার
বেশবাস অবিন্যস্ত, বলিষ্ঠ শারীরিক গঠন, দেখেই বোঝা যায় খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষ | পথিক
ভাবলো একবার এই লোকটাকেও জিজ্ঞাসা করে দেখা যাক |
পথিক : দাদা, এখানে কোনো পান-বিড়ির দোকান খোলা আছে কাছাকাছি ? অনেকক্ষণ
ধরে খুঁজে চলেছি | ওই নীল-সাদা বাড়ির এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তর দেবার বালাই নেই, কি সব আবোলতাবোল বকে গেল !
ভদ্রলোক : ওই নীল-সাদা বাড়ির লোক ? ওরা এই অঞ্চলের কিছু জানে? ওরা তো এখানে এসেইছে মাত্র ছয় বছর আগে | আমি
এখানকার পুরানো বাসিন্দা, এই অঞ্চলে আছি ওরা আসারও ৩৪ বছর
আগে থেকে | আমি আপনাকে বলছি, এই
ভরদুপুরে রোববার এখানে কোনো দোকান খোলা থাকে না |
পথিক : তাহলে উপায় ? আমার যে একটা সিগারেট নাহলে চলছে না আর !
ভদ্রলোক : সিগারেট তো পাওয়া যাবে না, তবে কাছাকাছি একটা বিড়ির কারখানা আছে,
সেখানে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি |
পথিক : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ | বিড়িতেও আপাতত কাজ চলবে | চলুন |
দুজনে ৩-৪ মিনিট হেঁটে এক বিড়ির কারখানার সামনে এসে পৌছয় | কারখানার ভিতর কতগুলো লোক তখনো বিড়ি বেঁধে
চলেছে |
ভদ্রলোক : এই দেখুন আমাদের দেশের অবস্থা- মুষ্টিমেয় কিছু
মানুষের হাতে সমস্ত সম্পত্তি পুঞ্জিভূত আর বাকি সব হলো সর্বস্বান্ত, শোষিত, অবহেলিত |
এর বিরুদ্ধে, এই বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদীদের
বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে | তাইতো বলি কমরেড....
পথিক (ব্যস্ত হয়ে): আরে
মশাই, দাঁড়ান | একটা বিড়ি খেয়ে নি | তারপর সব শুনব |
ভদ্রলোক : আরে বিড়ি খাওয়ার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে | আগে এই লোকগুলোর কথা ভাবুন | এদের জন্য আমাদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিন |
পথিক (কারখানার এক কর্মচারীর উদ্দেশ্যে) : ভাই, এক প্যাকেট বিড়ি হবে ?
কর্মচারী : আমরা এখানে বিড়ি বানাই, বেচি না |
পথিক (হতাশ হয়ে, ভদ্রলোকের প্রতি) : তাহলে আর কি ! আমি আসি |
ভদ্রলোক : আরে আসছেন কি মশাই, আমার কথা তো পুরো শুনে যান |
পথিক : না মশাই, একটু কাজ আছে | আমি চললাম |
ভদ্রলোক : বড় অকৃতজ্ঞ লোক তো আপনি মশাই | আপনার জন্য এত কিছু করলাম, আর আপনি আমাকে আধ ঘন্টা সময়ও দিতে পারছেন না | যান
আপনি, আপনার মতো লোকের জন্যই আজ দেশের এই হাল |
*******************************************************
পথিক আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো | খানিকদূর যাওয়ার পর দেখে সিগারেটে সুখটান
দিতে দিতে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে একজন ৫৫-৬০ বছরের বয়স্ক ভদ্রলোক আসছেন | লোকটির গলায় আবার একটা গেরুয়া রঙের স্কার্ফ |
পথিক : দাদা, আপনার কাছে আরেকটা সিগারেট হবে?
বয়স্ক ভদ্রলোক : মানে ? এটা কি ধরনের অভদ্রতা ?
পথিক : আমি আপনাকে অসম্মান করছি না | আসলে আমি আসছি বারাসাত থেকে, গোটা দুপুরটা এখানে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেছি | একটা
সিগারেট খেলে ক্লান্তি দূর হতো, কিন্তু এই সময়ে একটা দোকানও
খোলা নেই | তাই আপনাকে বলছি, যদি আপনার
থেকে একটা সিগারেট আমাকে দেন | আমি দাম দিয়ে দেব |
বয়স্ক ভদ্রলোক : দিতে পারি, একটা শর্ত আছে | ঘন্টাখানেক পর এখানে একটা সভা আছে,
আমরা রাজ্যসরকারকে একটা ডেপুটেশন দিতে চলেছি | আমাদের দাবী হলো মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার পর এই রাজ্যেও
গোমাংস কেনা-বেচা-খাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে | সেই উপলক্ষেই এই
সভার আয়োজন | তা কাজের কথাটা হলো, আপনাকে
আমার সাথে সেই সভায় যেতে হবে |
পথিক : মা গো ! একটা সিগারেটের জন্য এত কিছু !!!
বয়স্ক ভদ্রলোক: “মা গো” নয়, “গো মা” | আসল মা হলো গো-মাতা | ওনাকে রক্ষা করতেই হবে |
পথিক (রাগতস্বরে): পারেন বটে আপনারা ! নিজের মায়ের দিকে খেয়াল
নেই, নারীজাতির প্রতি সম্মান নেই, আর এদিকে গো-মাতার জন্য প্রাণ কাঁদছে !! মানুষকে আগে ভালবাসুন মশাই, তাদের জন্য
নিঃস্বার্থ ভাবে কিছু করুন, তারপর গোরু নিয়ে ভাববেন | তাছাড়া, সিগারেটের সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক ?? চাই না
আপনার সিগারেট, কি ফালতু জায়গা মশাই
! তখন থেকে একটা সহজ প্রশ্নের উত্তরে কিসব আলতু-ফালতু বলে চলেছে এখানকার লোকজন |
আমি চললাম মশাই এখান থেকে, যতসব উজবুকের দল !
পথিকের প্রস্থান | বয়স্ক ভদ্রলোক দশ সেকেন্ড ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন | অতঃপর নিজের মনেই বলে উঠলেন, “ঘোর কলি ! মা, রক্ষা কর !”
(অর্ঘ্য দাস, দুর্গানগর, ১৬-০৩-২০১৫)
lekhata khub bhalo ..
ReplyDelete