Skip to main content

ব্যোমকেশ, বিজ্ঞাপন এবং বাঙালীর হালচাল



বৃহঃস্পতিবারের সকাল দশটা | ১২ই মার্চ, ২০১৫ | সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী তার এম জি রোডের (পূর্ব নাম হ্যারিসন রোড) ভাড়াবাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে সিগারেটে সুখটান মারতে মারতে আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ছিল | সত্যবতী বাড়ি নেই, খোকাকে বগলদাবা করে সে তার দাদা সুকুমারের বাড়ি গেছে সপ্তাহখানেকের জন্য | অজিত একটু বেরিয়েছে, কাছেই কলেজস্ট্রিটে পাবলিশার্সের অফিসে গিয়েছে বকেয়া টাকা আদায় করতে | চাকর পুঁটিরাম ঘন্টা খানেক আগে জলখাবার দিয়ে গেছিল, আজ হয়েছিল কালো জিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে আলুর তরকারী আর ফুলকো লুচি |

আজকাল ব্যোমকেশের হাতে সেরকম কেস-টেস আসছে না | অবশ্য শুধু ব্যোমকেশ নয়, ফেলু মিত্তির সহ বাকি সমস্ত প্রাইভেট ইনভেষ্টিগেটরদেরও হাল একই রকম | আজকাল বাজারে ক্রাইম-টাইম যে কম হচ্ছে তা নয়, কিন্তু সব ক্রাইমেই আজকাল সরকার পক্ষের নাম চলে আসছে, আর তারপর সব কেস কম্প্রমাইসড হয়ে যাচ্ছে, সিবিআই পর্যন্ত স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারছে না | সুতরাং এসব ক্ষেত্রে ব্যোমকেশদের কেউ ডাকছে না , অবশ্য ডাকলেও সরকার আর নানা পার্টির চাপে এরা কিছু করতেও পারত না | অগত্যা এইসব বেসরকারী গোয়েন্দাদের অনেকেই সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে – “বিয়ের আগে/পরে ছেলে/মেয়ের গতিবিধি/অবৈধ সম্পর্ক/মিসিং/প্রতারণা – প্রমাণসহ গোপনে তদন্ত” টাইপের |
 
ব্যোমকেশ অবশ্য পেপারে বিজ্ঞাপন এখনো দেয়নি | ‘ক্লাস’ বলে একটা ব্যাপার আছে না !! বাঙালীর সেই স্টিরিওটাইপ অহংকার | যাইহোক, আজও অন্যদিনের মতই ব্যোমকেশ বিজ্ঞাপনের জায়গাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে | ব্যোমকেশের মতে, খবরের কাগজে যদি সত্যিকারের ‘খাঁটি খবর’ পড়তে হয় তাহলে বিজ্ঞাপনগুলোতে চোখ বোলাতে হবে | ও বলে, “দেশের কোথায় কি হচ্ছে, কে কি ফিকির বার করে দিন-দুপুরে ডাকাতি করছে, কে চোরাই মাল পাচার করবার নূতন ফন্দি আঁটছে – এইসব দরকারী খবর যদি পেতে চাও তো বিজ্ঞাপন পড়তে হবে |” (সূত্র- ‘পথের কাঁটা’ গল্প)

এই মুহূর্তে ব্যোমকেশ যেটায় চোখ বোলাচ্ছে সেটা হলো ১২ নম্বর পাতায় বিষয়-আশয়ের ঠিক নিচে ‘ফ্রেন্ডশিপ’ ব্যানারের নিচে প্রায় ৬৩ টা বিজ্ঞাপন | দুটো স্যাম্পেল নিচে দেওয়া হলো:
১. সাগরিকা: কোনরকম মেডিকেল চার্জ ছাড়া বন্ধুত্ব ও ক্লোজ রিলেশন, সাথে আয়ের সুযোগ | বিফলে ফি ফেরৎ | ফোন নম্বর: ..........
২. উষ্ণ ছোঁয়া: ফিক্সড ইনকাম পুরুষদের জন্য | হাই প্রোফাইল মহিলাদের সাথে সাথে বোল্ড রিলেশন করে আয় করুন | গভর্নমেন্ট রেজিস্টার্ড | ফোন নম্বর: ..........

মুচকি হেসে কাগজটা ভাঁজ করে আরেকটা সিগারেট ধরালো ব্যোমকেশ | সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস, সিগারেটের ক্রমবর্ধমান দামের কথা ভেবে | দুটো রিং বানিয়ে ছেড়েছে, এমন সময় ঘেমেনেয়ে অজিতের প্রবেশ | ঘরে ঢুকেই ফ্যানের নিচে আরামকেদারায় বসে ফস করে একটা সিগারেটে ধরিয়ে বললো, ভালো গরম পড়ে গেছে !! এটা যে বসন্তকাল কে বলবে !”

ব্যোমকেশ: তোমাদের মতো সাহিত্যিকেরা ছাড়া আর সবাই জানে যে কোলকাতায় দুটো ঋতু- গ্রীষ্ম আর বর্ষা | বাকিগুলো হাইপোথেটিকাল, মনের অলীক কল্পনা |

অজিত: তাই নাকি ? সে যাই হোক, কি করছিলে এতক্ষণ ?

ব্যোমকেশ: পেপার পড়ছিলাম |

অজিত: তোমার পেপার পড়া মানে তো বিজ্ঞাপন পড়া | তা নতুন কিছু পেলে আজ?

ব্যোমকেশ: বিশেষ কিছু না | তবে একটু অবাক লাগে এরকম খুল্লামখুল্লা ফ্রেন্ডশিপের বিজ্ঞাপন দেখে | একদম রাখঢাক না করেই সোজাসুজি কাজের কথা | যদিও পেশাটা আদিমতম, তবুও ভারতবর্ষের এরকম একটা লিডিং সংবাদপত্র প্রতিদিন এবিষয়ে একগাদা বিজ্ঞাপন ছাপছে দেখে একটু অবাকই লাগে | অবশ্য প্রত্যেকেই নিজের মুনাফা দেখে, বিজনেস ইজ বিজনেস | 
   
অজিত: হ্যাঁ, তবে শুধু ফ্রেন্ডশিপ নয়, ম্যাসাজ পার্লারের বিজ্ঞাপনও থাকে অনেক, “সুন্দর পরিবেশে সুন্দরী মহিলা দ্বারা ফুল বডি ম্যাসাজ এর মাধ্যমে পূর্ণ সতেজতা অনুভব করুন” গোছের | আজও আছে নিশ্চয়ই | কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় এই বিজনেসটা খুব ভালো চলছে বলতে হবে |  

ব্যোমকেশ: হ্যাঁ, তবে তোমাকে আর বিজ্ঞাপনের বয়ানটা বিস্তারিত ব্যাখা করতে হবে না | সাহিত্যিকগুলো আজকাল বড় পারভার্ট হয়ে যাচ্ছে | যেটা বলতে যাচ্ছিলাম, সারা বিশ্বে নিজেদের বুদ্ধিমান জাতি বলে বড়াই করে বাঙালী, আর আজকের পেপারের ৯ নম্বর পাতাটা দেখো – জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ হয়ে গেছে | আমরা নিজেরাই গাধা হতে রাজি আছি, ফলে আমাদের গাধা বানাবার লোকেরও অভাব নেই |

অজিত: তা যা বলেছ !!! সেই কোন কালে বরাহমিহির বলে গেছেন, “জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ / বলিতে পারে না বরাহ” | আর এরা তো দাবী করছে মাত্র একঘন্টায় বশীকরণ করে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে |

ব্যোমকেশ: তবে সবথেকে মজাদার হল ‘পাত্র চাই-পাত্রী চাই’ এর বিজ্ঞাপনগুলো | বাঙালীর উত্থান-পতন, সাধ আর সাধ্যের ফারাক, আকাশকুসুম চাহিদা, মানসিকতার ট্রানজিশন ইত্যাদি সবকিছুর যাবতীয় বিবরণ ওখানে থাকে | এক কথায় বাঙালী সমাজের দর্পণ বিজ্ঞাপনের ঐ পাতাটা | 

অজিত: হ্যাঁ, অপূর্ব সুন্দরী উচ্চশিক্ষিতা সর্বগুণসম্পন্না পাত্রী, অথচ ৩১ বছর বয়সেও পাত্রহীন | নির্ঘাত কোনো একটা বড়সড় গোলমাল আছে | আজকাল আর সেই যুগ নেই যে প্রেম করাটাকে মহাপাপ হিসাবে গণ্য করা হয়, না এরাজ্যে অনার-কিলিং প্রথা চালু আছে |

ব্যোমকেশ: হাঃ হাঃ | বড্ড বেশি একপেশে সিদ্ধান্তে চলে আসো তুমি খুব তাড়াতাড়ি |

অজিত: সে যাই বলো, আজ আর আমায় রাগাতে পারবে না তোমার ওই যুক্তিজাল বিছিয়ে | কোদালকে কোদাল বলতে শেখো |

ইতোমধ্যে পুঁটিরামের প্রবেশ | সে জানালো যে রান্না কমপ্লিট, ফলে বাবুরা যেন তাড়াতাড়ি স্নান করে খেতে বসে | অগত্যা আলোচনা মাঝপর্বে থামিয়ে ব্যোমকেশ চলল গামছা কাঁধে স্নানঘরের দিকে আর অজিত গেল জামাকাপড় ছেড়ে স্নানের জন্য তৈরী হতে |


Comments

Popular posts from this blog

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ১০ : ইতিহাস ক্লাস

**********************************************************************      “ ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল, অঙ্কেতে মাথা নেই, হয়েছি পাগল ”  বহুদিনের পুরোনো ছড়া  |  আমরা সবাই ছোটবেলায় এটা শুনেছি  |  ‘পাতিহাস’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানিনা, তবে দুটো মানে বের করা যায়  |  এক, পাতিহাস ডিম পাড়ে, আর ডিম মানেই স্যারের দেওয়া ‘গোল্লা’  |  অন্য মানেটা ক্রিকেটের ‘Duck’ যার অর্থও শূন্য  |  মোদ্দা কথা ইতিহাসে নম্বর পাওয়া দুষ্কর  |  “পরীক্ষার্থী হত ইতি উত্তর লেখবার সময়াভাব, সাময়িক স্মৃতিনাশ এবং স্যারের স্কেল মাপা চেকিং”  |   ফলাফল মুখের হাসিতে ইতি টেনে দেওয়ার উপযোগী মার্কশীট  | পাঠকমাত্রেই মানবেন যে ইতিহাসের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় সম্বন্ধ আছে  |  তা সে ইতিহাস বই হোক বা ইতিহাস ক্লাস  |  ছাত্রজীবনে সন্ধ্যাবেলা অন্য যেকোনো সাবজেক্ট পড়ার সময় দিব্বি জেগে থাকতাম. কিন্তু ইতিহাস বই খুললেই কেন জানি পাঁচ মিনিটেই ঘুম চলে আসতো ! আমি তো একবার ক্লাস নাইনে একবার ইতিহাস পরীক্ষা চলাকালীনই ঘুমি...

কাজের মাসি

কাজের মাসি গতকাল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে একটা লেখা পড়লাম কাজের মাসিপিসি দের নিয়ে | এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – তখন আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি আর থাকি গড়ফা নামক একটি জায়গায় মেসবাড়িতে | আমাদের মেসে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার ইত্যদি কাজ করত সবিতা দি | সদা হাস্যমুখ এই সবিতাদির বাড়ি ছিল নরেন্দ্রপুরে | মাঝেমাঝেই সবিতাদির নানা উদ্ভট কথাবার্তায় আমরা যারপরনাই পুলকিত হতাম | আমাদের মেসের মনোজিত আর সুদীপকে চিরকাল সবিতাদি ‘মনোদীপ ভাই’ আর ‘সুজিত ভাই’ বলেই ডেকে এসেছে, বহুবার সংশোধন করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি | আমাকে বলত ‘মোটাভাই’ | স্কচ বাইট কে বলত ‘কসবা’ | মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল কে বলত ‘মাছের তরকারী’ আর ‘মাংসের তরকারী’ | তখনো তৃনমূল ক্ষমতায় আসেনি, একদিন সবিতাদি এসে বলল, “ও ভাই জানো, আমাদের পাড়ায় কাল রাতে ঝামেলা হয়েচিল, এখন নতুন কি একটা পার্টি এসেচে না - ‘তিন আঙ্গুল’ না ‘দুই আঙ্গুল’ কি একটা নাম, তাদের সাথে ছি পি এমের | মারপিট ও হয়েচে |” আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন কোনো পার্টি সত্যিই বোধহয় এসেছে যাদের চিহ্ন ওই আঙ্গুলমার্কা ভিকট্রি সাইন ! মিনিট খানেক পর...

নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৩ - ঘন্টা, আলু এবং ব্রহ্ম

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের দৈনন্দিন আবাসিক জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এই ছোট্ট ছড়াটা - “ নরেন্দ্রপুরে সময় ঘন্টাময় , খাদ্য আলুময় , চিন্তা ব্রহ্মময়  | ” অনেকদিন আগে শোনা এই ছড়ার রচয়িতার নাম আমার জানা নেই , কিন্তু ছড়াটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এটা আমার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে  | ************************************************************ প্রথম ভাগ : ঘন্টা বাস্তবিকই আমাদের আবাসিক জীবন ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  |   ভোর পাঁচটায় rising bell শুনে ঘুম ভাঙতো , তারপর ঘন্টার তালে তালে সেই যে লেজ তুলে দৌড় শুরু হত , সেটা থামত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ , ‘lights out’ এর ঘন্টাধ্বনি শুনে  |   চার বেলা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার ঘন্টা , প্রার্থনা কক্ষে যাবার ঘন্টা , স্কুলে যাবার ঘন্টা , হোস্টেলে পড়া শুরু করার ঘন্টা , খেলতে যাবার ঘন্টা , রাত্রে শুতে যাবার ঘন্টা – আমাদের প্রতিটা কাজ ছিল ঘন্টা-নিয়ন্ত্রিত  | প্রতিদিন এই সময়ে-অসময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্য প্রত্যেক ভবনে (হস্টেলে) প্রতি মাসে দু’জন ছাত্রকে নিয়োগ করা হতো , এদের বলা হতো ‘...