অধুনা পশিমবঙ্গে শিয়ালদহ হতে বহুদূরে, একদম পৃথিবীর শেষ প্রান্তে অবস্থিত, বাংলাদেশ
সীমান্তের নিকটবর্তী ‘বনগ্রাম’ (চলিত ভাষায় ‘বনগাঁ’) নামক জনপদ পর্যন্ত একটি রেল
লাইন বিস্তৃত আছে | এটি লোকমুখে ‘বনগাঁ লাইন’ নামে পরিচিত | ভিড়ের জন্য এটি সমগ্র
বিশ্বে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে | শুধু বনগাঁ-গামী বা বনগাঁ থেকে আগত ট্রেন নয়, এই
লাইনের যেকোনো দুটি স্টেশনের সংযোগকারী ট্রেনেই সমপরিমাণ লোকসমাগম লক্ষ্য করা যায়
| অত্যন্ত রহস্যজনক ভাবে রবিবার বা বিভিন্ন ছুটির দিনেও এই লাইনের ট্রেনে
তিলধারণের জায়গা থাকে না |বনগাঁ লোকালে মানুষের ভিড়
সেই দেশভাগের সময়ে পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ভিড়ে ঠাসা ট্রেনগুলোকে অথবা
সেই ফেভিকল এর বিজ্ঞাপনের গাড়িটাকে মনে করায় |
একবার আমার এক
বন্ধুকে দুর্গানগরে আমাদের বাড়িতে আসার নেমন্তন্ন করেছিলাম | বেচারা আগে কোনদিন
বনগাঁ লাইনের ট্রেনে ওঠেনি, তাই শিয়ালদায় ট্রেনে ওঠার পর জানলার ধারের সিটে বসার
লোভ সামলাতে না পেরে কামরার একদম ভিতরের দিকে গিয়ে বসেছিল | এরপর ভিড়টা বাড়তে বাড়তে দমদম
স্টেশনে এসে প্রায় কুম্ভমেলার আকার নিলে বেচারা প্রমাদ গুনল | ট্রেন দমদম ক্যান্টনমেন্ট
স্টেশন পার করতেই ও মনে জোর এনে উঠে দাঁড়াল | অতঃপর সাতজনের পা মাড়িয়ে, দশ জনের
বগলের গন্ধ শুঁকে, তিন জনের কাছ থেকে গালাগালি খেয়ে, অন্ততঃ পনেরো জনের সাথে
রীতিমতো কুস্তি লড়ে যখন অবশেষে দুর্গানগর স্টেশনে এসে নামল তখন ওর পরণে ছিল কেবল
গেঞ্জি আর জাঙ্গিয়া | অমহাভারতীয় বস্ত্রহরণের এই পর্বে স্টেশন সংলগ্ন একটা দোকান
থেকে নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে কোনমতে শেষরক্ষা করা হলো | দুর্ভোগের একশেষ একেবারে !!!!
বনগাঁ লোকালে বসে
শুধু চোখ-কান-নাক খোলা রাখলেই দেশ-বিদেশের নানা বিষয়ের জ্ঞানপ্রাপ্তি ঘটে | যদি
মারাত্মক ঘামের গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসার উপক্রম হয় তাহলে বুঝতে হবে গরম
পড়েছে | যদি অক্সিজেনের অভাবে দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তাহলে বুঝতে হবে ঠান্ডা
পড়েছে, ফলে শীতকাতর বাঙালী জাতি গোটা ট্রেনে একটাও জানলা খোলা রাখেনি, শ্বাস
নেওয়াটা বাধ্যতামূলক না হলে বোধহয় মুখ আর নাকের ফুটোগুলোও বন্ধ করে রাখত !!! কামরায় দুর্গন্ধযুক্ত
হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের আধিক্য অর্থনীতির সূচক – বুঝতে হবে যে বাজারে ফুলকপি-মুলো
ইত্যাদি সব্জির দাম কমেছে এবং জোগান বেড়েছে | রাজনীতি আর খেলা (মূলতঃ ক্রিকেট আর
ফুটবল) সম্বন্ধে
যাবতীয় আপডেট ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জার’ নামক জনগোষ্ঠির আলোচনা থেকে পাওয়া যাবে | ভারতীয়
ক্রিকেট টিম খারাপ খেললে নতুন নতুন গালি-গালাজ শেখা যাবে | আর মহিলা কামরাগুলো যেন
সমাজতত্ত্বের এক একটা কোচিং সেন্টার – পাশের বাড়ির দাম্পত্যকলহ , পাড়াপড়শির এক্সট্রা-ম্যারিটাল
রিলেশন নিয়ে রসালাপ, বাড়িতে বাড়িতে শাশুড়ি-বৌমার কোন্দলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ - ইত্যাদি
সমস্ত বিষয়ে যাবতীয় জ্ঞানলাভ ওখানে হয়ে থাকে |
পৃথিবীর অন্য
সর্বত্রের মূল্যবৃদ্ধিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বনগাঁ লাইনের ট্রেনে হকাররা হরেক রকম
জিনিস বেচে থাকেন | পাঁচ টাকায় ছ’টা পেন কিংবা দশ টাকায় দশটা চিরুনি | ছাল ছাড়িয়ে
নুন মাখিয়ে বিক্রি হচ্ছে পেয়ারা, শসা ইত্যাদি | চার টাকায় জোড়া ‘ফলের রাজা’
মুসম্বি লেবু – ‘টক হলে পয়সা ফেরৎ’ | এছাড়াও বাতের ওষুধ, দাদ-হাজা-চুলকানির মলম,
চাচা চৌধুরীর কমিকসে পড়া বৈদ্যরাজ চক্রমাচার্যের ওষুধ (যেটা খেয়ে রাকা অমর হয়ে
গেছিল), গ্যাস-অম্বল-বুকজ্বালা সারাতে হজমিগুলি ও
আমলকি চূর্ণ – সবই মিলছে জলের দরে, শুধুমাত্র সেদিনের জন্য নাকি সেটা
কোম্পানির অফার, পরের দিন থেকেই নাকি দাম বেড়ে যাবে !!! শিক্ষার প্রসারে বিক্রি হচ্ছে জেনারেল নলেজ , অঙ্কের
ম্যাজিক, ইংরাজি ভোক্যাবুলারির বই, বেণীমাধব শীলের ফুলপঞ্জিকা | ‘যে কোনো মাল দশ
টাকা’র ব্যানারের নিচে বিক্রি হচ্ছে নেইল-কাটার, কান খুঁচানোর কাঠি, বাসন মাজার
স্কচবাইট, বাচ্চাদের জন্য খেলনা | টুকটাক সময় কাটানোর জন্য আছে মশলামুড়ি, কাঁচা
ছোলা মাখা, ডালমুট, সল্টেড বাদাম, ঝাল মটর, চিঁড়েভাজা, ‘মোগলাই-চানাচুর’ | এছাড়াও
আছে সদ্যপ্রস্তুত গরম দিলখুস কিংবা গজা, শনপাঁপড়ি | এককথায় বনগাঁ লাইনের কামরা যেন
চলমান ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, যেখানে ‘মেট্রো ক্যাশ এন্ড ক্যারি’র মতো সারাবছর
ডিসকাউন্ট চলছে |
‘সেন্স অফ হিউমার’ নামক জিনিসটি যে একটি জড়পদার্থের থাকতে পারে সেটা এই লাইনের
ট্রেনে যারা চলাচল করেননি তারা হয়ত জানেন না | আপনি হয়তো বিরাটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে বনগাঁ-গামী ট্রেনের অপেক্ষা করছেন, তখন দেখবেন উল্টো দিকের
লাইন দিয়ে পরপর তিনটে শিয়ালদা-গামী ট্রেন চলে গেল, এদিকে আধঘন্টা ধরে আপনার
ট্রেনের দেখা নেই | আপনি ভাবলেন যে আপনার গাড়ি আসতে দেরী আছে, এই ভেবে আপনি
ঝালমুড়ির দোকানে গিয়ে একটা পাঁচ টাকার মুড়িমাখার অর্ডার দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা
হলো আপনার ট্রেন আসছে | মুড়িওয়ালা তড়িঘড়ি করে মুড়ি মেখে আপনার হাতে দিলো, আপনি দশ
টাকার নোট দিলেন, দোকানদার খুচরো বার করার জন্য পকেটে সবে হাত ঢুকিয়েছে, এমন সময়
ট্রেন হাজির | আপনি ধর্মসংকটে, একদিকে পাঁচ টাকার লোকসান অন্যদিকে ট্রেন মিস হবার
চান্স – এমন সময়ে ট্রেন হুইসল দিলো, আপনি ব্যালেন্সটা ফেরৎ নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে
কোনোমতে ট্রেনটায় উঠলেন | বিশ্বাস করুন, এরকম অভিজ্ঞতা এই লাইনে যাতায়াতকারী
প্রতিটা মানুষের একাধিকবার হয়েছে |
আপনি যদি আগে কখনো বনগাঁ লাইনের ট্রেনে না চড়ে থাকেন,
তাহলে আপনার উদ্দেশ্যে বলছি – চলে আসুন একদিন এদিকে, জীবনে তো খামখেয়ালের বশে অনেক কিছুই করলেন, তাহলে এটাই বা
বাদ যায় কেন !!! সকাল সকাল শিয়ালদা থেকে বনগাঁর একটা রিটার্ন টিকিট কেটে
চেপে বসুন ট্রেনে, বনগাঁ আসুন, ফিরে যান অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে নিয়ে | এটা আপনার একটা
লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট হয়ে থাকবে |
(চিত্রঋণ: ইন্টারনেট)
________________
© অর্ঘ্য দাস
দুর্গানগর, ০২-০৩-২০১৫
________________
© অর্ঘ্য দাস
দুর্গানগর, ০২-০৩-২০১৫
ebar to dekhchi bonga local ekdin chaaptei hobe :D
ReplyDeletesatti bongaon local ..lekhata valo
ReplyDelete