নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur) : পর্ব ৪ : হিন্দি-শিক্ষার ধাক্কা: “উল্লু কা পাঠ্ঠা” এবং “শয়তানী মুলো”
“ভাইসাব
আপলোগ হিন্দি মে বোলতা কো বোলতা নেহি বোলতা তো কেয়া বোলতা?”- ছোটবেলায় এই চুটকিটা
শোনেনি এরকম বাঙালী খুঁজে পাওয়া যাবে না | এটা বাঙালির হিন্দি-বচন কে ব্যঙ্গ করেই বানানো | পরবর্তীকালে যারা কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যান,
তাদের কমবেশি সবাইকেই এই বিষয়ে খানিকটা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে হয় – যার মধ্যে
এটা প্রায় সর্বজনীন: “আপ বাঙালী লোগ তো সবকুছ খাতে হ্যায় – চাওয়াল ভি, পানি ভি অউর
সিগারেট ভি…..!!!” |
বাঙালী জাতির এই
বদনাম ঘোচানোর উদ্দেশ্যেই বোধহয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে আমাদের তৃতীয়-ভাষা
হিসাবে হিন্দি পড়বার একটা ব্যবস্থা ছিল এবং অন্য অপশন সংস্কৃত-এর তুলনায় এটি
অধিকতর জনপ্রিয় ছিল | আমাদের
সময়ে স্কুলে দু’জন হিন্দী শিক্ষক ছিলেন – শ্রী রামকুমার উপাধ্যায় এবং শ্রী রামলক্ষ্মন
খান |
প্রথম গল্প:-
সেদিন ছিল
আমাদের প্রথম হিন্দী ক্লাস (ক্লাস সিক্স, ১৯৯৭-৯৮ সাল), রামকুমারদা ক্লাস নিচ্ছেন | ভদ্রলোক সজ্জন এবং গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন | সেদিন সবে
আমাদের অক্ষর পরিচয় হল |
অ-আ-ক-খ শেখানোর পর স্যার প্রশ্ন করলেন যে আমরা বুঝেছি কিনা এবং আমাদের কোনো
জিজ্ঞাস্য আছে কিনা | সবে
বর্ণপরিচয় হয়েছে আমাদের, ফলে কিছুই জিজ্ঞাস্য থাকা উচিত নয়, আমরা সবাই চুপচাপ বসে
আছি, হঠাৎ করে আমাদের বন্ধু রাবণ (ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস) দাঁড়িয়ে উঠে বললো : “স্যার,
একটা প্রশ্ন করবো?”
স্যার: বোলো বেটা বোলো, কী প্রশ্ন আছে?
রাবণ: স্যার, ‘উল্লু কা পাঠ্ঠা’ মানে কি?
হঠাৎ করে চোখের সামনে যেন ভেল্কিবাজি হয়ে গেল – স্যারের একটা চিৎকার
শুনতে পেলাম আর পরমুহূর্তে দেখলাম স্যার ডায়াস-এর উপর যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলেন
সেখানে শুধু স্যারের চটিদুটো পড়ে আছে | অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি স্যার রাবণের প্রায় গলা
টিপে ধরেছেন আর রাবণ তখন কৈবল্যদশা প্রাপ্তির পথে | স্যার যে ডায়াস থেকে
ক্লাসের মাঝখান অব্দি অতবড় একটা লংজাম্প দিতে পারেন সেটা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও
অসম্ভব ছিল !! ভাগ্যক্রমে সেদিন তক্ষুনি ক্লাস শেষ হওয়ার বেল বেজে যাওয়ায় বেচারা
রাবণের ছেলেপুলেরা অনাথ হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল | স্যার চলে যাওয়ার পরে আমরা
সবাই রাবণকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞাসা করায় ও
বলেছিল যে ছোটবেলা থেকেই নানা হিন্দী সিনেমায় এই কথাটা ও শুনে এসেছে, কিন্তু এটার মানেটা ওর জানা
ছিল না, তাই আজ প্রথম সুযোগেই ও এই প্রশ্নটা করেছিল | কিন্তু জ্ঞান অন্বেষণের
পথে যে এরকম একটা বিপর্যয় ঘটতে পারে সেটা ও আন্দাজ করতে পারেনি | পরে আমরা জেনেছিলাম ‘উল্লু
কা পাঠ্ঠা’ এর মানে হলো ‘পেঁচার বাচ্চা’, বা সাধারনভাবে ‘বোকা-হাবা’ | স্যার বোধহয় ভেবেছিলেন রাবণ ইচ্ছাকরেই স্যারকে অপদস্থ
করার জন্য এই প্রশ্নটা করেছিল !
দ্বিতীয় গল্প:-
এই গল্প
আমাদের ক্লাস এইট-এর | আমাদের
হিন্দি ক্লাস নিতেন রামলক্ষ্মণদা | তখন
আমরা খানিক বড় হয়ে গেছি, ভালোমতই লেজ গজিয়ে গেছে, ফলে নানা ক্লাসেই আমরা স্যারদের
নানারকম ভাবে জ্বালাতন করতাম | তা এই হিন্দি ক্লাসে হতো কি, মাঝেমাঝে স্যার যখন
ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু লিখতেন তখন আমরা কয়েকজন (বিশেষতঃ আমি আর ইন্দ্রদীপ) হাসাহসি, নানারকম
অদ্ভুত আওয়াজ ইত্যাদি করতাম আর স্যার আমাদের দিকে ফিরলেই চুপ করে যেতাম | স্যার তখন বলতেন “হুমমম...!!! শয়তানী মুলো খেয়ে শয়তানী
ঢেঁকুর তোলা হচ্ছে?” |
বলাবাহুল্য এতে আমরা একটুও ভয় পেতাম না এবং স্যার ওদিকে ঘুরলেই আবার শুরু করতাম | ফলে কি হতো স্যার খানিক পরে লেখা বন্ধ করে আমাদের কাছে
এসে আমাদের পৃষ্ঠদেশে একটি করে বিরাশি সিক্কার পাঞ্জা বসিয়ে চলে যেতেন | আমরা তখনকার মতো চুপ করতাম বটে, তবে দিন দুই-তিন যেতে না
যেতেই আবার শুরু করে দিতাম এবং যথারীতি একটি করে কিল খেতাম | কেন জানিনা, অন্যান্য স্যাররা বকলে বা মারলে খুব খারাপ
লাগতো, কিন্তু রামলক্ষ্মণদার ক্লাসে কিল খেতে একটুও খারাপ লাগতো না, বলা ভালো পুরো
ক্লাসের সাথে আমরাও এটা খানিক উপভোগ-ই করতাম |
![]() |
রামলক্ষণ দা
|
© অর্ঘ্য দাস, দুর্গানগর
(মাধ্যমিক - ২০০২ সাল)
(মাধ্যমিক - ২০০২ সাল)
Comments
Post a Comment