নরেন্দ্রপুরের স্মৃতিকথা (Memoirs of RKM Narendrapur):পর্ব ২ - সরস রসায়ন ক্লাস : ‘ফিল্টার কাগজ হেঁয়াও’
________________________________________________________________________
ছোটবেলায় জিজিবি (শ্রী গৌরহরি ঘোষ বাগ, G.G.B.) স্যারের ক্লাস ছিল নিতান্তই আনন্দদায়ক | রসায়ন-এর রসাস্বাদনের এর কথা বলছি না, আসলে ওই ক্লাসে আমরা নির্ভেজাল আনন্দ করতাম,
অনর্থক স্যারের পিছনে লাগতাম বা বন্ধুদের সাথে খুনসুটি করতাম | কিন্তু স্যার আমাদের একটুও বকতেন না | স্যার একবার বাড়ি
থেকে মুলো না ফুলকপি কি খেয়ে এসেছিলেন জানিনা, কিন্তু সেদিন স্যার-এর খুব ঢেঁকুর
উঠছিল- কি একটা হিজিবিজি বিক্রিয়া পড়াতে গিয়ে ‘ফিল্টার কাগজ’ শব্দদুটো বলেই
‘হেঁয়াও’ বলে স্যার প্রকান্ড একটা ঢেঁকুর তুললেন – সেদিন থেকেই ওনার নাম হয়ে গেল ‘ফিল্টার কাগজ হেঁয়াও’ ( ভিন্নমতে ‘ফিল্টার কাগজ
ভেউ’) |
স্যার ভীষণ ভালোমানুষ আর বন্ধুসম ছিলেন
- একবার নরনারায়ণ সেবার দিন আমি ওনার সাথে গল্প করতে করতে ওনার ভুঁড়ি-তে সুড়সুড়ি
দিয়ে ফেলেছিলাম আর একবার উনি ক্লাসে আসার আগে আমি দরজার পিছনে লুকিয়ে ছিলাম, উনি
আসামাত্রই লাফিয়ে সামনে এসে, অনেকটা চোর-পুলিশ খেলায় ‘ধাপ্পা’ বলার কায়দায়, ‘গুড
মর্নিং’ বলে স্যারের পিলে চমকে দিয়েছিলাম – কিন্তু এতকিছুতেও উনি একটুও রাগ করতেন না
|
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সবসময়েই স্যারের সবেধন-নীলমণি ছিল একটি ডায়েরি, সেখান থেকে তিনি বেশ
দ্রুতগতিতে আমাদের নোটস ডিক্টেট করতেন | জিজিবির ছাত্রমাত্রেই একথা জানে | আমি ক্লাসে স্যারের
ঠিক সামনের সিটেই বসতাম, স্যার নোটস বলার মাঝে কিছু একটা ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার জন্য
চেয়ার ছেড়ে উঠে যেই পিছন ফিরতেন তখন মাঝেমাঝেই আমি ডায়রির পাতাটা উল্টিয়ে অনেকগুলো
পৃষ্ঠা এগিয়ে বা পিছিয়ে দিতাম, এরপর স্যার আবার যখন আমাদের দিকে ফিরে ডায়রির লেখা
পড়তে যেতেন তখন বেশ হকচকিয়ে যেতেন, তারপর অনেক কষ্টে খুঁজেপেতে আবার সেই পৃষ্ঠাটা
বার করতেন ! এরকম নানা দুষ্টুমি আমরা জিজিবির ক্লাসে করতাম |
ভূমিকা পর্ব সেরে আসল গল্পে আসি | এটা ২০০১-০২ সালের
কথা, আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি, কেমিস্ট্রি ক্লাসে স্যারের নোটস বলার গতির সাথে তাল
মিলিয়ে লিখতে না পারলে না পারলে আমাদের বন্ধু ঋতম মাঝেমাঝেই স্যারকে রীতিমতো ধমক
দিয়ে বলত “আস্তে বলুন..!!! লিখতে পারছিনা” অথবা “ধুর..!! আবার বলুন,
লিখতে পরিনি” কিংবা “এত
তাড়াতাড়ি বললে লিখব না কিন্তু !” ইত্যাদি ইত্যাদি | আর স্যার-ও ভালোমানুষের মত রিপিট করতেন | কিন্তু সেই বিশেষ দিনটিতে কোনো একটা
কারণে স্যার এর মুড একটু অফ ছিল | ক্লাস চলছে, স্যার নোটস দিচ্ছেন, হঠাৎ করেই সুদীপ তারঃস্বরে গলা ছেড়ে গেয়ে
উঠল, “টিয়া টিয়া টিয়া/ অজ পাড়াগাঁয়ে থাকে/ ট্যাঁরা চোখে তাকায় টিয়া.....”- গান টা শেষ হতে পারল না,
তার আগেই ধুমধাড়াক্কা মার মেরে বসলেন স্যার সুদীপকে | ( কোন মানসিক উৎফুল্লতার কারণে আচমকা সুদীপ অমন করে চিল্লিয়ে
উঠেছিল কেন কে জানে !!) জীবনে সেদিন প্রথম এবং শেষবারের মতো জিজিবি স্যারের ক্লাসে
‘পিনড্রপ সাইলেন্স’ হতে দেখেছিলাম | খানিকপরে স্যার কিছুটা শান্ত হয়ে আবার নোটস দিতে শুরু করলেন- কিন্তু এদিন উনি
মারাত্মক গতিতে বলতে লাগলেন, আমরা সবাই হিমশিম খেতে লাগলাম লিখতে গিয়ে, বেচারা ঋতম
সেদিন প্রায় কিছুই লিখতে পারছিল না – শেষে একদম মরীয়া হয়ে উঠে ঋতম উঠে দাঁড়িয়ে
বলল, “স্যার, প্লিজ একটু ধীরে ধীরে বলবেন, প্লিজ?” আমরা সবাই মারাত্মক চমকে গিয়ে ঋতম-এর
মুখের দিকে তাকালাম- বলাবাহুল্য এরকম শান্ত, নম্র, বাধ্য ঋতমকে আমরা কেউই চিনতাম
না | সেদিন বুঝেছিলাম ‘মারের
ভয়’ কাকে বলে !!!
পুনশ্চঃ - সেদিন ক্লাসের শেষে যাওয়ার সময় স্যার
দুঃখপ্রকাশ করে সুদীপকে ‘সরি’ বলে গিয়েছিলেন – এতটাই ভালোমানুষ ছিলেন উনি |
![]() |
গৌরহরি ঘোষবাগদার সাথে আমরা ক্লাস 10 E-এর ছাত্ররা (২০০২ সাল)
|
___________________________
© অর্ঘ্য দাস ( মাধ্যমিক ২০০২ ব্যাচ ),
দুর্গানগর, ২১-০২-২০১৫
NOTE
: To read more articles on RKM memoirs, click here
Comments
Post a Comment